।। সম্পাদকীয় ।।


মোবাইলের ক্যামেরা নিয়ে ছেলেখেলা করাটা আমার পেশার মধ্যে না পড়লেও আমার নেশার মধ্যে অনেকাংশেই পড়ে। তবে আমার কাছে হঠাৎ এইরকম একটা কজ করার ব্যাপারটা, কোনো দূর্ঘটনা বললে ভুল হবে না। কোরোনার তাড়ায় যখন পৃথিবী সুদ্ধ লোক নিজ নিজ আদি আস্তানায় ফিরে যাচ্ছে, তখন সেই তাড়া খেয়ে আমিও এসেছিলাম ১৫ দিনের জন্য। কিন্তু সেই ১৫ দিন যে ৫ মাসে পরিণত হতে পারে সেটাও একটা দুর্ঘটনা বললে ভুল হবে না । বাড়িতে বসে থেকে নাজেহাল হওয়া ছাড়া উপায়েই বা কি ছিল তখন। প্রথম প্রথম ভেবেছিলাম, সাধারণ মানুষদের বেশিদিন চারদেয়ালের মধ্যে রাখাটা সম্ভব নয় কিন্তু সোশাল মিডিয়ার অমানবিক ট্রোল, খাকি বাহিনীদের উদুম পিটুনির সিসিটিভি ফুটেজ গুলো মানুষের মনে এক অন্যরকম অনুভূতির সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল। পেনডেমিক পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও, স্কুল বা কলেজ খোলার মতো ফাটাফাটি রিক্স কেও নিতে চাইছিলেন না। পরিবর্তন অনেক কিছুই হল, শুরু হল অনলাইন ক্লাসের যুগ । যে ছেলেটা কোনোদিন ক্লাসের চৌকাঠে পা রাখেনি সেও আজ নিয়মিত গুগল মিটের বৈঠকখানায় মন দিয়েছে । আবার এর উল্টটাও হয়েছে অনেকের ক্ষেত্রে , হয়তো তাদের মধ্যে আমিও রয়েছি । এমন একখান পরিস্থিতিতে বাড়িতে বসে মোবাইল মন্থন, গল্প বই পড়া আর সিনেমা দেখা ছাড়া হাতে আর কোনো কাজ ছিল না বল্লেই চলে । কিন্তু ঠুঁটো জগন্নাথের মতো বসে থাকাটা শরীরের পক্ষে পুষ্টকর হলেও মনের ক্ষেত্রে কোনোমতেই নয় । অঙ্ক খাতার ফাঁকা পাতাগুলোতেও কিছু গল্পেরা জমাট বেঁধে ছিল । যদিও আমি আগেই পরোক্ষভাবে উল্লেখ করে দিয়েছি যে শাল কাঠের সজারুর জন্ম সামান্য কিছু ঘটনা ঘটার মধ্য দিয়ে হয়েছে । আমাদের শর্ট ফিল্ম বানানোর খুবই ইচ্ছা ছিল , সেই ইচ্ছা গুলোকে বাস্তবায়ন করতে আমরা এমন উদ্যোগ গ্রহণ করেছি, এমনটা একদমই নয় । জঙ্গলমহলের কোভিড পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক হওয়ার পর আমরা কিছু বন্ধুরা মিলে কাজ শুরু করি । প্রধানত বাংলা ভাষা, সাহিত্য , জঙ্গলমহলের নিজস্ব সংস্কৃতি ও আঞ্চলিক ভাষার চর্চা এবং সেগুলো মানুষের কাছে তুলেধরার জন্যই শাল কাঠের সজারুর অঙ্কুরোদগম । এবং সেই উদ্যোগ সজীব রেখেই আজ আমরা রুখামাটি সাহিত্য পত্রিকার প্রথম বর্ষ প্রকাশিত করতে পেরেছি ।
এই কাজের সফরে যেমন বাধা পেয়েছি তেমনি মানুষের কাছে অনেক ভালোবাসাও পেয়েছি । আমাদের কাছে পুজোবার্ষিকী প্রকাশ করা একটা লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছিল । কিভাবে লেখা আসবে , লেখক বা লেখিকা কোথায় পাবো , আদৌ লেখক বা লেখিকাদের কাছে আমাদের আওহান পৌঁছবে কি না! ইত্যাদি ।
তবে এই লড়াইয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাশে ছিলেন টিম শাল কাঠের সজারু এবং টিম নিঃস্বার্থ-এর সকল সদস্যরা । মাননীয়া ডঃ সঙ্গীতা নায়ের , আমরা যাকে ম্যাডাম নামে চিনি তিনিও এ লড়াইয়ে পাশে ছিলেন । সব শেষে আপনারা যখন এই পত্রিকাটি পড়ছেন তখন এটা নিশ্চিত যে এই লড়াই আমরা জিতেছি । এখন সব মিলিয়ে পাঠকদের যদি বইটা ভালো লাগে তাহলেই আমাদের সব পরিশ্রম স্বার্থক হবে । শাল কাঠের সজারুর তরফ থেকে সকলের জন্য রইল শারদীয়ার শুভেচ্ছা ও আন্তরিক ভালোবাসা ।


- সত্যজিৎ দত্ত

( শাল কাঠের সজারু )




|| ধন্যবাদান্তে টিম নিঃস্বার্থ ||



জঙ্গল মহল মানেই একটা জংলী জংলী ভাব,এই ভাবনা অনেকের মধ্যেই দেখেছি। জঙ্গল মহল মানেই হাড় লিকলিকে মানুষের ছবি, এটাই তো চেনা ছবি। জঙ্গলমহল মানেই বড়ো জোর ওই ফুটবল খেলতে পারে, এই পর্যন্তই। এর বাইরে গল্প, কবিতা, রম্য রচনা এই সব ওদের কাজ হতে যাবে কেন? কিন্তু আমরা যদি একটু ভালো করে লক্ষ্য করি জঙ্গল মহলের অলিতে গলিতে একটা নিজস্ব গান যেন অহরহ বিরাজ করছে। আপনি বিশ্বাস করুন ঝুমুর আপনাকে মাতিয়ে দিতে পারে, ভুলিয়ে দিতে পারে শহুরে জীবনের হানাহানি,খুনোখুনি। জঙ্গলমহলের কবিদের কবিতায় প্রস্ফুটিত হয় শাল,পিয়ালের আপন ছন্দ। এখানের মানুষের জীবন যদি এত সহজ সরল হয়,তাহলে গল্পের কাহিনী জটিল হয় কী করে?
আমাদের যখন বলা হলো শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষ্যে একটা পত্রিকা বার করা হবে এবং আহ্বান করা হল আমাদের সহযোগী হওয়ার জন্য। সহমত হতে আমরা দুবার ভাবিনি । কারণ "টিম নিঃস্বার্থ " তো এটাই করে আসছে।জঙ্গল মহলের কৃষ্টি, সাহিত্য, গান ,কলা সমাজের মূল স্তরে সমানে সমানে টক্কর দিক। সবাই জানুক জঙ্গল মহল মানেই শুধু দারিদ্রতা নয়,এখানেও সাহিত্যের সাধনা হয়।
এই পত্রিকা প্রতি বছর প্রকাশিত হবে, এই আশা রাখি। যারা যারা আমাদের এই প্রয়াসে অংশ গ্রহণ করলেন,তাদের সহ সবাইকে বাঙালির বড়ো উৎসব- দুর্গা পুজোর অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
সবাই পুজোতে মজা করুন,আনন্দ করুন। তবে অবশ্যই সোশ্যাল ডিসটেন্স মেইনটেইন করুন। আর অবশ্যই আমাদের পত্রিকার লেখা গুলো পড়ুন। আপনারা পড়লেই, আমাদের পরিশ্রমের সার্থকতা। আপনাদের মতামতের অপেক্ষায় রইলাম।

- বাপি খান

( টিম নিঃস্বার্থ )




|| ছোটগল্প ||






দানশীলতা

-হারাধন দত্ত

আমাদের পাড়ার নিধুবাবু একজন পুণ্যাত্মা ব্যক্তি। তিনি পুণ্য সঞ্চয়েই সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করেছেন ।নিজের দানশীলতার কথা নিজের মুখে বললে যদি কিছুমাত্র পুণ্যক্ষয় হয় সেই ভয়ে তিনি তাঁর দানশীলতার সমস্ত বিবরণ একটি ডায়েরিতে লিখে আমাকে পড়তে দিলেন ।
তিনি প্রথমেই লিখেছেন যে তাঁর বাবা সবসময় বলতেন দানই পরম ধর্ম । দান-ধ্যান করলে পুণ্য সঞ্চিত হয়। প্রথমে বলেছেন রক্তদানের কথা । তিনি নাকি প্রতি মুহূর্তেই রক্ত দান করে চলেছেন । আজন্ম দান করা এই রক্তের হিসাব করলে গোটা কয়েক জল রাখা ট্যাঙ্ক ভর্তি হয়ে যাবে বলেই তাঁর ধারণা। "ওরা এসে এক শরীর করে রক্ত নিয়ে যায়। ওরা যখন-তখন আসে... ।" 'ওদের'-কে আটকানোর কোনো চেষ্টাই তিনি করেননি । নিধুবাবুর বক্তব্য হলো --- "আমি তোমাদেরকে রক্ত দিচ্ছি, তোমরা আমাকে পুণ্য দাও ।" পাপ হওয়ার ভয়ে নিধুবাবু 'ওদের' গায়ে কখনও হাত তোলেননি। এই 'ওদের' -কে মানে 'কিউটি পাই মশকিউটো ভাই'দেরকে রক্ত দিতে গিয়ে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু হয়েছে বেশ কয়েকবার কিন্তু তাতে ওনার কোনো হেলদোল নেই । এখনও মশারি বা মশা তাড়ানোর ধূপ , কয়েল বা অয়েল ব্যবহার না করে ওদেরকে অবাধে রক্ত দান করে তিনি গোছা গোছা পুণ্য সঞ্চয় করে চলেছেন ।
এরপরেই নিধুবাবু উল্লেখ করেছেন অর্থদানের কথা । ঘর থেকে বেরোনোর সময় তিনি পকেটে করে দশ পয়সা , কুড়ি পয়সা , চারআনা, আটআনার কয়েনগুলো সঙ্গে নিয়ে নেন । ট্রেনে , বাসে কত ভিখারিকে যে তিনি অর্থদান করেছেন তার ইয়ত্তা নেই ।
আর এই কিছুদিন আগে বাতিল হওয়া ছোটো ষোলোআনার কয়েনগুলো তো মন্দিরের পুরোহিত এবং সাধু-সন্ন্যাসীদেরকে দান করে অনেক আশীর্বাদ কুড়িয়ে নিয়েছেন ।
নিধুবাবু তারপরে বলেছেন বস্ত্রদানের কথা । তাঁর শতছিন্ন পাজামা-পাঞ্জাবি , তেল চিটচিটে , ইঁদুরে কাটা স্যান্ডো গেঞ্জিগুলো বস্তিবাসীদের মধ্যে দান করতে পেরে তিনি তো বেজায় গর্বিত। এবার দুর্গাপুজোয় ঘরমোছা কাপড়গুলো দুঃস্থদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে নাম কুড়িয়েছেন ভালোই ।
গরীব ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্যও তিনি সদাই চিন্তা করে চলেছেন । গতমাসেই তাঁর শেষ হওয়া 'প্রেমিকার দ্বারে পাঠাতে গিয়ে বাবার মারে না পাঠানো প্রেমপত্রের হিজিবিজি' আর 'আজগুবি হাবিজাবি জলছবি' -এর খাতাগুলো বস্তির ছেলেমেয়েদেরকে দান করলেন । আর সঙ্গে উপরি পাওনা হিসেবে তাদের জন্য ছিল তাঁর ব্যবহৃত কালি শেষ হওয়া কলম , নিবভাঙা কলম , আধভাঙা পেনসিলগুলি । সাক্ষরতার পথে ছেলেমেয়েগুলোকে একধাপ তুলে দুধাপ টেনে নামানোর খুশি তাঁর দানকার্যকে সাফল্যমণ্ডিত করল ।
বাড়িতে খাবার খুঁজতে আসা ভিখারীদের তাড়িয়ে দিলেও তাদের কখনোই অভুক্ত থাকতে দেন না তিনি । তাঁর দানশীল হাত সদাই তৎপর , উদগ্রীব , উৎকন্ঠিত অপরের ভালো করার জন্য । বাড়ির ডাস্টবিনে জমা গন্ধ-ওঠা , পোকাধরা খাবারগুলো যত্ন করে ফেলে আসেন রাস্তার ধারে যাতে চারপেয়েদের সাথে মারপিট করে দুপেয়েগুলোও খেয়ে কোনোক্রমে প্রাণধারণ করতে পারে ।
এছাড়াও তাঁর ছোটোখাটো দান-ধ্যানের বর্ণনায় পাঁচশো পাতার ডায়েরিটা ভর্তি হয়ে গেছে । বাজার থেকে কিনে আনা পচা লাউ-কুমড়োগুলো বউ ফেলে দিতে চাইলে তিনি ওগুলো পাড়ার ছেলেগুলোকে দান করে দেন ফুটবল খেলার জন্য । আর পচা ডিম থাকলে দিয়ে আসেন স্থানীয় পার্টি অফিসে। কারণ ওরা তো দিনরাত কাদা ছোড়াছুড়ি করছেই, নাহয় একটু পচা ডিম ছোড়াছুড়ি করেই আনন্দ পাক ।
নিধুবাবু আবার মুরগিও দান করেছেন কয়েকবার। এবছর বার্ড ফ্লু-তে মরা মুরগিগুলো তো তিনি কাল্টুদার মাংসের দোকানে দিয়ে দিয়েছেন । কিন্তু কোনো টাকা নেননি ।
প্রতিদিন বাজার গিয়ে সবজিওয়ালাদের সাথে উত্তপ্ত বাক্য আদানপ্রদানে তার চেয়ে পটু দ্বিতীয় ব্যক্তিটি আর নেই এ তল্লাটে ।
মিষ্টি কথা বলে পটিয়ে পাটিয়ে সুলভে মাছগুলো বাগাতে না পারলে মাছওয়ালাকে তো দুটো পিঠে প্রদান না করে কোনোমতেই ছাড়েন না সদাহাস্য নিধুবাবু ; সাথে আবার কিছু উপাদেয় কাঁচা খিস্তি দানে মাছওয়ালার কর্ণেন্দ্রিয়কে তুষ্ট করে তবেই বাড়ি ফেরেন তিনি ।
তারপর বাড়ি ফিরে এসে স্ত্রীর মুখ ঝামটা , মুড়ো ঝাঁটার বাড়ি-এর প্রতিদানে সোশ্যাল মিডিয়া আর 'অঙ্গভঙ্গি বিভঙ্গি ভিডিও' গুলো দেখে শেখা অরুচিকর ভঙ্গিমার সুচতুর প্রয়োগে নাক কচলে মুখ ভেঙচে স্ত্রীর চোখে জল এনে দিয়ে তবে দুদন্ড শান্ত হয়ে বসেন আমাদের মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত নিধিরাম চক্রবর্তী মহাশয়।
নিধুবাবুর সূক্ষাতিসূক্ষ মহৎ দানকার্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণে আমার পাঠক মনে দোলা লাগলো । আর ঘোলা হয়ে যাওয়া চোখের কোণে জমা হলো বেশ খানিকটা নোনা জল । তাই ডায়েরিটা তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিলাম যাতে না ভিজে যায় । তারপর একমনে নিজের ব্যর্থ জীবনের কথা ভাবতে লাগলাম । দান-ধ্যান না করার ফলে তো এ পাপী জীবনে প্রতিদিন পাপের বোঝা আরও একটু একটু করে বেড়েই চলেছে ।
হঠাৎ নিধুবাবুর ডাকে আমার চিন্তায় ছেদ পড়লো । আমি চোখ মুছে ডায়েরিটা নিধুবাবুর হাতে ধরিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসছিলাম সেইসময় নিধুবাবুর স্ত্রী রান্নাঘর থেকে রাতের উপাদেয় , লোভনীয় , জিভে জল আনয়নকারী খাদ্যসামগ্রী ---- ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেন নিয়ে ঘরে ঢুকলেন । আমি তখন চুপ করে দাঁড়িয়ে লোভাতুর দৃষ্টি প্রদান করে ঘ্রাণের মাধ্যমে অর্ধভোজনের কাজে মনোনিবেশ করলাম ।
আর এদিকে নিধুবাবু তার দানপ্রক্রিয়ার কিছু নমুনা প্রদর্শন করার জন্য খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে এলেন । তারপর গালে সজোরে এক চপেটাঘাত ও পশ্চাৎদেশে তারচেয়েও জোরে পা দিয়ে স্পর্শকাতর এক অনুভূতি প্রদানের মাধ্যমে আমাকে বাড়ির রাস্তা দেখালেন ।
নিধুবাবুর এই বিশাল , অসাধারণ দানকার্যের নিদর্শন আমার মতো আরও হাজার হাজার সাধারণ মানুষের শুধু যে মনেই আছে তাই নয় সেগুলো লেপ্টে রয়েছে গালে , কপালে , বগলের চুলে , ওষ্ঠে , প্রকোষ্ঠে , শ্বাসকষ্টে আর উর্ধ্ব , অধঃ , অগ্র , পশ্চাৎ সকল দেশেই ।








সর্ব গেল অস্তাচলে

- সত্যজিৎ দত্ত
(১)

সোনাই হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে সাদা টিনের বাক্সটা খুলে কিছু খোঁজার চেস্টা করছে। বাইরে রাখা পুরানো পেন্ডুলাম ঘড়িটি ঢং ঢং করে ৩টে বাজল। সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই, সে আপন মনে টিনের বাক্সটা খতিয়ে যাচ্ছে। অস্বস্তিকে জলাঞ্জলী দিয়ে কিছু একটা যেন সে খুঁজে বেড়াচ্ছে ওই সাদা টিনের বাক্সের মধ্যে। পরমুহূর্তেই তার মুখে এক খানা অদৃশ্য পৈশাচিক হাসির ভেসে উঠে এবং তৎক্ষনাৎ মিলিয়ে যায় কৌতূহলি মুখের পেছনে। বাক্স থেকে একটা কালো রঙের ছবির অ্যালবাম খুজে পায়। সেটাকে তার পড়ার টেবিলে এনে, টেবিল লেম্পটা জালিয়ে চেয়ারে বসে মনোযোগ দিয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে আছে।
তাহলে এতো রাতে কি এই সামান্য ছবি অ্যালবামটা দেখার জন্য সোনাই ঘুম থেকে উঠে হম্বিতম্বি করে এটাকে খুজে বার করল? নাকি অন্য কিছু ?!
এমন কি আছে এই অ্যালবামে?
কোথাও কোনো আওয়াজ নেই। যেন পুরো পৃথিবীটা শব্দহীন হয়ে গেছে অথচ এ পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যার কোনো শব্দ নেই। সোনাই একটার পর একটা পাতা উল্টিয়ে যাচ্ছে। এই নিঃশব্দ পরিবেশে এখন একটি শব্দ শোনা যাচ্ছে, যেটা হল অ্যলবামের পাতা উল্টানোর শব্দ। অ্যালবামের প্রতিটি পাতায় একটি করে ছবি। একটার পর একটা পাতা উল্টিয়ে যাচ্ছে সোনাই। মা, বাবা, দাদা, দিদি, প্রীতম, সত্য, কৌশিক, আকাশ, আরো অনেকের ছবি আছে। সব ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎই একটি পাতায় তার দৃষ্টি আটকে গেল। এ কি?
সেই পাতাটায় সৌভাগ্যের ছবি, আর সেই ছবির ওপর যেন কেউ লাল কালি দিয়ে ক্রস দাগ কেটেছে। সৌভাগ্য আজ বছর তিনেক আগে মারা গেছে। এই অ্যালবামে তার ছবি থাকার কথা নয় বা পুরোনো বন্ধু হিসেবে থাকলেও লাল কালির দাগ টা এলো কিভাবে।
সোনাই এই ছবিটি অ্যালবামে প্রথম দেখল। আগে অনেকবার অ্যালবামটা দেখেছে, ছবিটা দেখেনি, কিন্তু ওই লাল দাগটা তার খুব চেনা। অনেকদিন আগে এই দাগটা দেখেছিল কৌশিকের বাবার ছবিতে, এই অ্যালবামেই । এইসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার ঘুমটা ভেঙে গেল। হাঁপাতে হাঁপাতে কপালে জমে থাকা ঘাম গামছা দিয়ে মুছে, তাড়াতাড়ি রুমের লাইট গুলো জালিয়ে দিল। তার পাশেই কৌশিক ঘুমাচ্ছে। হুড়মুড়িয়ে উঠে কৌশিকের ঘুম ভাঙানোর চেস্টা করতে লাগল। প্রায় সকাল হয়ে এসেছে, কিন্তু ল্যাদখোর ছেলে হলে যা হয়, ওঠার নাম নেই। অনেক ডাকা ডাকির পর কৌশিক রেগে মেগে উঠল।
- " ভাই.... ভাই ওঠ "
- " ধুর... এতো সকালে ডাকা ডাকি করছিস কেন। "
- " আরে ওঠ না ভাই। "
ল্যাদ প্রিয় কৌশিক কোনোরকমে উঠে বলল- " এই যা বলার তাড়াতাড়ি বল, আমার ঘুম পাচ্ছে খুব। "
সোনাই আমতা আমতা ভাব নিয়ে বলল - " সেই কালো অ্যলবামটাতে আজ সৌভাগ্যের ছবি দেখলাম। "
- " দেখ সোনাই সকাল সকাল এসব বাজে বকার কোনো মানেই হয় না। বেশ কয়েকদিন ধরে দেখছি তোকে... কালো অ্যালবাম, কালো অ্যালবাম করে চেচিয়ে যাচ্ছিস। যা যা ফালতু মাথা খারাপ করিসনা ঘুমোতে দে। "
সোনাই আবার বলতে শুরু করল- " আর তাতে লাল রং দিয়ে ক্রস কাটা ছিলো, ঠিক যেমন টি তোর বাবা মারা যাবার পরদিন তোর বাবার ছবিতে ছিল, হুবুহু। "
কৌশিক এই সব কথা শুনে রেগে মেগে বলল- " তুই কি বলতে চাইছিস বলতো ? কোন লোকটা মরবে না বাঁচবে সেটা ওই উদ্ভট কালো অ্যলবামটা সংকেত দেয় ? "
- " আরে সংকেত কোথায় দেয়। যারা মারা গেছেন তাদের ছবি ভেসে আসে এবং ভেসে আসে রক্তমার্কা সেই বিশ্রী দাগটা। " - " তোর কালো অ্যালবাম রাখ তোর কাছেই, কোনোদিন তো আমাকে ওই অ্যালবাম দেখাতে পারলিনা।
মনেপড়েছে... হ্যাঁ চল... চল তোর কালো অ্যালবাম টা দেখাবি চল। কোথায় আছে সেটা। "
সোনাই সাদা বাক্সের দিকে ইসারা করে দিল। কৌশিক সেই বাক্সটা খুলে তন্নতন্ন করে খোঁজার চেস্টা করছে । পাশ থেকে সোনাই বলে উঠল- " আমি অনেক খোঁজার চেস্টা করেছি, কিন্তু বাস্তবে তা কখোনোই সম্ভব হয়ে উঠেনি, একমাত্র স্বপ্নেই ওই কালো অ্যালবামটা বাক্সে থাকে। "
কৌশিক বলল - " ইয়ার্কি হচ্ছে ? সকাল সকাল ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলিতো, তুই বেরো। বাড়ি মালিকের সাথে আমি আজই কথা বলব, তুই এই রুমে থাকতে পাবি না। পুরো মেন্টাল আছিস তুই। তোর সাথে, একই রুমে থাকা কোনোমতেই সম্ভব নয়। "
এই ভাবে একতরফা একটা ঝগড়া হয়ে গেল দুজনের মধ্যে। সোনাই রুম ছেড়ে দিল। কৌশিক আর কথা বলেনা তার সাথে।

(২)

সোনাই নতুন রুমে ঢুকেছে। অনেক খোঁজা খুঁজি করে একটা মেস জুটেছে কাছাকাছি। ইদানিং তার একটা নতুন বন্ধুও হয়েছে, পাশের রুমেই থাকে। রোজ রাতে কিছুক্ষণ তারা আড্ডা দিয়েই নিজ নিজ রুমে চলে যায়। তাই বলে কি এতো দিনের বন্ধুত্ব ভুলে যাবে সোনাই। কৌশিককে তার মাঝে মাঝেই মনে পড়ে। দেখা হলেউ কৌশিক আর তার সাথে কথা বলে না।
আবার সোনাই সেই সাদা টিনের বাক্সটা খুলে কালো অ্যালবামটা বের করে ছবি দেখছে। যথাক্রমে মা, বাবা, দাদা, দিদি, প্রীতম, সত্য , কৌশিক, আকাশ, আরো অনেকের ছবি আছে তাতে। কিন্তু এটা কি?....
কৌশিকের ছবিতে সেই পরিচিত রক্তমার্কা বিশ্রি লাল কালির দাগ ফুটে উঠেছে। দেখে সোনাইয়ের গা হিম হয়ে গেছে। তার পর অন্য পাতা গুলো আরেকবার দেখতেই তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এল । অ্যলবামের প্রতিটি ছবি এখন সেই লাল দাগের শিকার। মা, বাবা, দাদা, দিদি, প্রীতম, সত্য, কৌশিক, আকাশ, আরো যতো জনের ছবি ছিল সব ছবিতেই ওই রক্তাক্ত বিশ্রি লাল কালির দাগ ফুটে উঠেছে। ছবির সংখ্যা ক্রমশই বেড়ে চলেছে। অ্যলবামে আরো অপরিচিত অনেক মানুষের ছবি ফুটে উঠছে ক্রমাগত। মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে গা এলিয়ে চেয়ারে শুয়ে পড়ল সোনাই। ঢুলু ঢুলু চোখে সিলিংএর দিকে তাকিয়ে আছে, হঠাৎই একটা দমকা হাওয়ার সাথে অস্পষ্ট ক্ষীণ শব্দ তার কানে বিঁদে উঠতে লাগল। শব্দটা যেন ধীরে ধীরে গভীর হয়ে আসছে। পরমুহূর্তেই এক বিকট শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল। তাড়াতাড়ি রুমের সব কটা আলো জ্বালিয়ে দিয়ে বসে পড়ল বিছানায়।
ভয়ে তার গলা শুকিয়ে গেছে, বতুল থেকে কিছুটা জল খেয়ে চটি জোড়া পরে বারিয়ে পড়ল কৌশিকের কাছে।
তার রুমে তন্নতন্ন করে খুঁজেও তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না । মা, বাবা, দাদা, দিদি, প্রীতম, সত্য, কৌশিক, আকাশ সবাইকে একের পর এক ফোন করতে লাগল।
কেউ আর ফোন তুলল না।
যেখানে প্রচুর মানুষের আনাগোনা সেই রাস্তা টা খাঁ খাঁ করছে...। ফুটপাতে একটা ভিখারিও নেই । তাহলে সোনাই কি এই পৃথিবীতে একা বেঁচে আছে? এক জায়গায় থমকে দাড়িয়ে রয়ে গেল সোনাই, ধীরে ধীরে আঁধার নেমে এল। স্বপ্নদেশের কালো অ্যালবাম হয়ে উঠল বাস্তবের অভিশপ্ত আয়না।
সোনাই এই পৃথিবীর একটি শেষ প্রান হিসাবে রয়ে গেল, আর বাকি সর্ব গেল অস্তাচলে।







নোনা বৃষ্টি

- সৌরভ সিনহা

বৃহস্পতিবার পুরোটা দিন পঞ্চায়েত অফিসের কাজ আর কাঠফাটা রোদের পর বিকেলবেলা বাড়ি ফেরার সময় লক্ষণ দা -র দোকানে চা খেতে ঢুকে দেখলাম যে, আসর জমেই রয়েছে। কাঁধের ব্যাগটা পাশে নামিয়ে রেখে বসলাম আমিও। নৃপেণ বাবু তখন আমাদের গ্রামের কৃষকদের দুর্দশার বর্ননা দিচ্ছিলেন, আর 'কিশলয়' থেকেই দেখছি যে নৃপেন বাবু কোনো কথাই সোজা করে বলতে পারেননা। আসলে স্বৈরাচারী সরকারের অনেক দোষত্রুটির সাথে এবছরের এই অনাবৃষ্টিতেও চাষিদের কাল হয়ে দেখা দিয়েছে। ফলে স্বভাবতই সারাদেশে বাড়ছে কৃষকদের আত্যহত্যার হার। আর আমাদের হরিরামপুরেও এরকম ঘটনা ঘটছে কয়েকটা। সেগুলো নিয়ে কথা হতে লাগলো আর নৃপেন বাবু ও তার সঙ্গী সাথীরা বিরোধীদলের লোক বলে, যে দল ক্ষমতায় আছে, তাদের দোষ দিতে লাগলেন। সেই সময় লক্ষ্য করলাম যে, পাশের হনুমান মন্দিরটার সামনে বেশ ভীড়। ভীড় বলতে কিছু জীর্ন কাপড় পরা দরিদ্র বাচ্চা ছেলে মেয়ে, যাদের চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় যে তারা কতটা ক্ষুধার্ত আর অসহায়। সকলে শুনেছিলাম যে আজকে মন্দিরে কিছু অসহায়, অনাথ শিশুদের খাবার দেওয়া হবে ৷ এই বাচ্চা গুলো খাবার পেলে তাদের মুখের হাসিটা কেমন হবে সেটা ভেবে মনটা একটু ভালো লাগল। কিছুক্ষন পর চায়ে চুমুক দিতে দিতে আচমকা শুনতে পেলাম, মন্দিরের দিক থেকে, একটা মোটা গলা ভেসে আসছে। তাকিয়ে দেখলাম পুরোহিত মশাই, একটা বাচ্চাকে তার নাম জিজ্ঞেস করছেন। হয়তো বাচ্চাটার গলায় কালো সুতো দেখেই এরকম প্রশ্ন। ছেলেটা একটু কাতর ভাবে তার নাম বলল - নাজমুস সাকিব। এরপর সবার দৃষ্টি পড়ল বাচ্চাটার দিকে। ছেলেটা বুদ্ধিমান, কিছু না বলাতেই লাইন থেকে সরে গেল।
কিন্তু পুরোহিত মশাই তৎক্ষণাৎ জায়গাটিতে গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিয়ে নিজেকেও শুদ্ধ করার লক্ষে পুকুরের দিকে দৌড় লাগালেন। তখনও কিছু লোকে সেই একই রকম ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চলে যাচ্ছিল ছেলেটা , হতাশ হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল বজরংবলীর দ্বার থেকে , হঠাৎ কে যেন তার হাতটা ধরল । পিছনে ঘূরে দেখল যে তারই মতোই একজন তবে তার গলায় কালো সুতো না থাকার কারনে এখন তার হাতে খাবারের প্যাকেট। তার থেকে কিছুটা খাবার সে শাকিবের দিকে এগিয়ে দিলো । সেই দৃশ্যের ছবিটা তুলে রাখলে হয়তো আমিও আজকে একজন মহান ফোটোগ্রাফার হিসেবে পরিচিত হতাম । শাকিবের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যেন এবার সে সত্যি খুব খুশি । হঠাৎ তার হাতে একটা ঝটকা লাগল । আর সেটা একটা সাদা টুপি পরা লোক। ইনি মুসলমান পাড়ার পুরহিত। তিনি শাকিব কে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে এসে বললেন যে এটা হিন্দু বাচ্চাদের খাবার জায়গা , তিনি তাকে আর আসল জায়গাতে নিয়ে জাবেন । এটা বলে তিনি তাকে নিয়ে মসজিদের রাস্তা টার দিকে এগিয়ে গেলেন। শাকিবের চোখে জল, আর সেই ছেলেটাও কাঁদছে! হয়তো সেদিন রাতটা তাদের আর খালি পেটে ঘুমোতে হবে না । তবে তাদের মধ্যে যে বিশ্বাসের সেতু টা তৌরী হয়ে ছিল সেটা যেন একটা ধাক্কায় ভেঙ্গে গেলো । দুজনেই তখন ধর্মীয় বেড়া জালে আবদ্ধ। এখন সময় ‘আবহাওয়া ঘন্টার পরিবতিত হয় ‘এটা প্রমান করার জন্যই যেন বৃষ্টি শুরু হল । এ বছরের প্রথম বৃষ্টি । সবাই খুব খুশি, নপেন বাবু বললেন যে মন্দিরে দরিদ্র বাচ্চাদের সাহায্য করার জন্য এটা শ্রী হনুমানের দান । মুসলমানেরা হয়ত ভেবে ছিল যে শাকিব কে হিন্দুদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এটা আল্লাহ র উপহার । কিন্তু আমার ওই বৃষ্টির জলটা লবনাক্ত মনে হল । একই বৃন্তের দুইটি কুসুমের মধ্যে যে এত গুলো পোকা লেগে গেছে সেটা দেখে দুঃখে সৃষ্টিকর্তার চোখের জলই যে এই বৃষ্টির উৎস তাতে কোনো সন্দেহ নেই ।।








সাবস্টিটিউট

- সৌমেন্দু বাগ

জানলা দিয়ে হুশ করে হাওয়ার দমকাটা মুখে লাগতেই চমকে উঠে ঘড়ির দিকে তাকালাম।
'মেঘ উঠেছে রে, জামাগুলো সব তুলে নিয়ে আয়…"
পূবদিকের দিগন্ত ফেলে উঠে আসছে জমাট অন্ধকার। জামাকাপড় চুলোয় যাক, বারান্দার এক কোনে পড়ে থাকা ফুটবলটাকে বুকে আঁকড়ে দে ছুট। দিশেহারা হাওয়ায় তখন কাদা মাখা ঘাসের গন্ধ। নীলু, ছোট্টু, সন্তু, রানা, গুপ্তা সবাই হয়তো এসে পড়বে। আসতেই হবে। আজ যে সানঘাটার সাথে ম্যাচ।
টুপটাপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মাঠের ধারে এতক্ষনে কালো-লাল-নীল ছাতার এলোমেলো ভিড়। সানঘাটা আবার বাইরের মাঠে চিৎকার করবার জন্য ছেলে ভাড়া করে নিয়ে যায়। এতক্ষণে ওদের হৈচৈ শুরু হয়ে গেছে হয়তো। এমনিতেই হোম ম্যাচে জিতে তেতে আছে। কিন্তু আজ আমাদের মাঠে ম্যাচ। আমরাও ছেড়ে কথা কইবো না!
কিন্ত একি! চারিদিক এত শুনশান কেন? অন্য দিন সোনাকাকু, তরুনজেঠুরা মাঠে যাওয়ার পথে ডেকে টিপস দেন। আজ কারোর পাত্তা নেই? ম্যাচের কথা ভুলে গেল নাকি সব। কিন্তু আমি ভুলিনি। হারের প্রতিশোধ নিতেই হবে।আমি যদিও সেরকম খেলতে পারি না। সাইডলাইনে বসে চিৎকার করি আর নেহাৎ কেও চোট পেলে আমার ডাক আসে। সাবস্টিটিউট। আমার প্রত্যেক টা ব্যর্থ ট্যাকল দেখে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া তিন্নি মুখ টিপে হাসতো, রানা না বললে জানতেও পারতাম না।ওই যে সাবস্টিটিউট।
কিন্ত একি! চারিদিক এত শুনশান কেন? অন্য দিন সোনাকাকু, তরুনজেঠুরা মাঠে যাওয়ার পথে ডেকে টিপস দেন। আজ কারোর পাত্তা নেই? ম্যাচের কথা ভুলে গেল নাকি সব। কিন্তু আমি ভুলিনি। হারের প্রতিশোধ নিতেই হবে।আমি যদিও সেরকম খেলতে পারি না। সাইডলাইনে বসে চিৎকার করি আর নেহাৎ কেও চোট পেলে আমার ডাক আসে। সাবস্টিটিউট। আমার প্রত্যেক টা ব্যর্থ ট্যাকল দেখে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া তিন্নি মুখ টিপে হাসতো, রানা না বললে জানতেও পারতাম না।ওই যে সাবস্টিটিউট।
কিন্তু আজ এখনো কেও আসেনি কেন? ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে মাঠটা একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেন তাকে কেউ কথা দিয়েছিল আসবে, পেনাল্টি শুট করে কাকভিজে হয়ে করা উদ্দাম নাচবে, কিন্তু কই?
গুপ্তার দাদু বারান্দা থেকে রেডিও নিয়ে আমাদের খেলা দ্যাখে। ওই তো আজও আছে।রেডিও থেকে ভাঙা ভাঙা গলায় ভেসে আসছে - " আকাশবাণী কলকাতা, শান্তিনিকেতন বিভাগ। অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছে 101.3 কিলো হার্টজ তরঙ্গে। এখন ক্যানেলের মাঠে অনুষ্ঠিত চাকলামাঠ বনাম সানঘাটপাড়া ম্যাচের ধারাবিবর্ণী শোনানো হচ্ছে.... সন্তুর বাড়ানো বলটা বুক ছুঁইয়ে নামিয়ে আড়চোখে একবার ডানদিকটা দেখে নিলো নীলু। ওপাশ থেকে ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো তেড়ে আসছে বিশাল বপুর লোকনাথ। চেহারার জন্য লোকনাথের ঘুরতে সময় লাগে। অসামান্য দক্ষতায় নীলু তার পায়ের ফাঁক দিয়ে বলটা বের করে নিজে প্রায় শুয়ে ছিটকে বেরিয়ে এলো। তারপরই বলটা নিয়ে ছুটলো সামনে, সামনে শুধুই গোলকি, তার পেছনেই অমোঘ তেকাঠি। সারা মাঠ জুড়ে চিৎকার। ওদের গোলকির নামে দ্বিগুন হলে , নিলুর নামে চারগুন জোরে চেঁচিয়ে ফাটিয়ে দিচ্ছে ছেলেগুলো।
এমন সময় কেও কানের কাছে বলে গেল, একি? তুই এখনও এখানে? সানঘাটা তো ফার্স্ট হাফে দুগোল দিয়ে দিয়েছে। মাঠে প্রচন্ড কাদা। সন্তু খোঁড়াচ্ছে। তুই তাড়াতাড়ি যা। তিনটে গোল লাগবে জিততে। অন্তত তোর চিৎকারটাও দরকার। দেরি করিস না…
দেরি হয়ে যায়। প্রত্যেকবার। ছুটছি আমি...ছুটে চলেছি ক্যানেলের মাঠের দিকে। চোখ বন্ধ করলে ক্লাস এইট-নাইন, বিকেল চারটে,তিন্নির জানলা, আমার ব্যর্থ ট্যাকল, গলা ফাটিয়ে চিৎকার - সবকিছু আবছা হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছে দূরে, আরো দূরে। একফালি আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনের দৌড় দৌড়চ্ছি। ছুঁতে পারছি না কিচ্ছুটি। চেতনার ওপার থেকে ভেসে আসছে ঝরে -জলে-ফুটবলে চিৎকারের শব্দ - নীল-উ-উ-উ...নীল-উ-উ-উ...





|| কবিতা ||







হ য ব র ল

- রূপক চট্টোপাধ্যায়
 
পোড়া হৃদয়টাকে বিকিয়ে দিলাম সহজ লভ্য দামে। জানিস না তুই রোদ বয়সী পাখিরা কোথায় নামে? তোর নামের ভেতর ভীড় এড়ানো শহর ছাড়া পথে। চলতে গিয়ে আলাপ করা চন্দ্রাবলী হাতে। মাথুর খন্ড ফুরিয়ে আসে হাড়ের বাঁশিটি বাজে। কান্না কাজল মেঘ এলায়ে রাধার মতই সাজে । নেশায় যখন পা টলে যায় নদীর জলে ছন্দ। তোর দুয়ারে আঘাত করি হৃদয় মহল বন্ধ! তখন আবার একলা হাঁটা আকাশ খুলে একা। আলতো মেঘে নামিয়ে রাখি সুদূর পথের পাখা। মাথায় ঝড়ের আদিম বাজে বুকের ছায়ায় শান্তি। রোদ্দুর হতেও পারি নি হায়, নই তো অমল কান্তি। তবু পোড়া হৃদয় ধোঁয়াটে হলে সহজে কি কালো চমকায় ? তোর প্রেমিক, এখনো এসে ম্যাসেজ করে ধমকায়। আমি তো ফকির লালন হয়েছি ক্লিওপেট্রায় তোর রূপটান। সহজ লভ্য হৃদয় জুড়েও ফুরিয়ে এলো রে ভুল গান।






বেঁচে থাকার আর্তি

- সঙ্গীতা পাল
 
প্রকাশ্য দিবালোকে হয় মনুষ্যত্বের ধর্ষন নীরবে সহ্য্ করছে আজকের জনগণ। আজ না হয় বাল্মীকির মেরুদন্ড ভেঙেছে আমাদের মেরুদন্ড ভেঙেছে অনেক আগে। মণীষার জিভ আজ কাটা হয়েছে আমরা চিরকাল থেকেছি বোবা হয়ে । এখন ধর্ষণ এদেশের অলঙ্কার, স্নেহান্ধ ধৃতরাষ্ট্রের স্নেহের ছায়ায় প্রিয় দুর্যোধন দুঃশাসনের অত্যাচারে ধর্ষিত হচ্ছে মানব সমাজ ৷ দিকে দিকে শোনা যায় শুধু মনীষাদের আর্তনাদ বেঁচে থাকার আর্তি৷ কামান্ধ পশুরা শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত থাকে না নারী শরীরটাকে খুবলে খুবলে খায় রাস্তার কুকুরের মতো, তারপর তার হাড়গোড় ভেঙে ফেলে দেয় নির্জন কোনো রাস্তায় বা রেললাইনের ধারে। এভাবেই কি ধর্ষকরা ঘুরে বেড়াবে প্রকাশ্য দিবালোকে, ছাতার নিচে রোদ বৃষ্টি থেকে বাঁচতে বাঁচতে ৷ মেয়েরা কি কোনোদিনও স্বাধীন ভাবে বাঁচবে না৷ মনীষার ঘটনায় আজ কাঁপছে সারাদেশ কবে পাবে দোষীরা ফাঁসির আদেশ৷ ধর্ষক নামের নরপিশাচ গুলো কোনোদিন কি বিলুপ্ত হবেনা ?






লাঞ্ছিতা দ্রৌপদী

- জয়দেব মণ্ডল
 
যে দেশে ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ সেখানে গান্ধারীও যদি চোখে কাপড় বেঁধে থাকে, যেখানে পাণ্ডব দ্যুত ক্রিড়ায় মত্ত, সেখানে দুর্যোধন দুঃশাসনের অত্যাচারে দ্রৌপদী হবে লাঞ্ছিতা এ আর নতুন কথা কি! মহাভারতে রয়েছে প্রমাণ তার ৷ কে দোষী ? দ্রৌপদীর পোষাক ছিলনা অশালীন, পাপ ছিল কৌরবের মনে, আর রাজা ছিল অন্ধ৷ নির্ভয় কৌরব দ্রৌপদীর চীর হরণে ক্ষান্ত থাকেনা আজ, বিকৃতকামনার শিকার সভ্য যুগের নারী৷ সতীত্ব, নারীত্ব কামনার হাতে বিসর্জন দিয়ে এক বুক জ্বালা নিয়ে মুখে দিয়ে তালা লজ্জার ভয়ে বসে থাকে ঘরে অনিশ্চিত বিচারের আশায়৷






অবরোধ

- কল্লোল মন্ডল
 
অবরোধে থেমে গেছে প্রেমিক। কাটাকুটি খেলার পর বিদীর্ণ বুকের উপর  আঁকা মস্ত পাহাড়। তোমার ঠিকানার খোঁজ জানতে পেরে রোদের আদরে হেসেছে রাস্তার দুপাশের উর্বর ধানক্ষেতে। সে যেন এক অপরূপ সৌন্দর্য্য! বিকেলের সোনালী অক্ষরে বাঁধা হয়েছে নৌকার মাঝির ঘরে ফেরার গানের সুর। অবেলায় ঘরের দেওয়ালে ছাপা হয়েছে, সাংবিধানিক অধিকারের বিবরণ! তুমি ফিরবে না বলেই, প্রত‍্যাগমনের মিছে গল্পে বিচ্ছেদ লেখা থাকে শিরোনামে! লোক ঠকিয়ে চলে যাওয়ার সহজ রাস্তায় এবার কাঁটা বিছিয়েছে সরকার! প্রাচীনের ওপারে প্রাচীরের কান্না শুনেও অভিযোজনে মজে রইলে চিরটা কাল। শব্দ ফুরিয়ে গেলে আর কি লেখার কিছুই থাকে না! ভাবতে ভাবতে এক সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ে গোটা সভ‍্যতার বুকের ওপর। তাকিয়ে দেখি, কবিতায় দেখা প্রেমিকার মতো মেয়েটি তখন সবে স্নান করে  তার ভেজা চুলের ঢেউয়ে তোলপাড় করেছে গোটা দেশ!






আমিও আসছি

- গোপীনাথ মন্ডল
 
দেখতে দেখতে কেটে গেলো একটা বছর, আমি ভেবেছিলাম বসন্ত এলো বুঝি, তুমি বাড়িয়ে দিয়ে অবহেলা, চলে গেলে একলা। আজ এক বছর কোনো ফুল ফোটেনি, কোনো ভ্রমর মধু সংগ্রহ করেনি, সে কথা তুমি জানো ? ব্যালকনিতে যে গাছ টা তুমি লাগিয়ে ছিলে, মুমূর্ষু হয়ে পড়ে আছে, বোধয় তুমি নেই বলে। তোমার মনে পড়ে, যখন কলেজের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে- এক দাদু ঠাকুমা কে দেখে, তুমি বলেছিলে, আমরা এরকম ভাবে থাকবে চিরকাল। তখন কি ভেবেছিলাম এরকম ভাবে- হঠাৎ চলে যেতে হবে তোমায় কোনোদিন। একটা বছর হয়ে গেলো, একবার খবর নিলে না বলো। শেন নদীর ধারে- তোমার সেই আইসক্রিম খাবার বায়না, তা শুনে আমার সেই কি হাসি, এখনো ভুলতে পারিনি। তুমি চলে যাবার পর- শান্তি দি রান্না করা ছেড়ে দিলো, তুমি জানোই তো- রান্না করতে মোটেও ভালো লাগেনা আমার, পাঁচ ফোড়ন এর গন্ধে আমার এলার্জি। তুমি জানো, আমি আসছি খুব শীগ্রই তোমার কাছে, আজ আমার রিপোর্ট এসেছে পজিটিভ। তুমি থাকলে খুশি হতে খুব, সারাজীবন নেগেটিভ ভাবা লোকের- রিপোর্ট তো পজিটিভ বলো। চারিদিকে কিছু নেই, এক অবাক বিসন্নটা। তুমি জানো আমার পাশের বেডে ছিলো, এক ২৫ বছরের ফুটফুটে তরতাজা তনয়া, হঠাৎ করে সে চলে গেলো। আমি ভাবছি সেই ছেলেটা র কথা, যে স্বপ্ন দেখেছিল তাকে নিয়ে ঘর বাঁধার। ওর কথা শুনে, কলেজ জীবনের কথা মনে পড়ছিল খুব, তুমি জানো। এটা সেই আর এন ট্যাগোর গো, কতবার আমরা এসেছি চেকআপ করাতে, কিছুই তো হলোনা শেষ অব্দি বলো! সন্তান না থাকার কষ্টটা, তুমি বুঝতে দাওনি কোনদিন, আমাদের সমস্ত সম্পত্তি, তোমার বানানো অরফ্যান্ট-হাউস-এর ছেলে মেয়েদের নামে করে দিলাম। আজ আর পারছি না, অন্ধকার নেমে আসছে ঘনিয়ে চোখের সামনে, শ্বাস নিতে পারছি না, নার্স দিদি আজ মুখে একটা নল দিয়ে গেলো, ভেবে ছিলাম, জীবনের শেষ কটা দিন খোয়াই নদীর ধারে, হাতে হাত রেখে কাটাব, সেটা আর হলোনা। আমি আসছি !!!!!






ফিরে দেখা

- অরুনিমা দত্ত
 
ব্যস্ত সবাই, তবু রোজ মন চায়, ফিরে যেতে ভালোবাসার অলি-গলি তে। সেই গলিপথ গুলো আজ, আধুনিকতা,পরিপক্কতার স্যাঁতসেঁতে শ্যাওলায় ঢাকা। আর, বৃষ্টিতে ভিজতে চাওয়া মেয়েটার, একটা দুটো মরা ইচ্ছের কবরখানা। তবু বহুযুগ পর, একটা মনখারাপী বিকেল, কিম্বা জীবন রেসের মাঠে, রনক্লান্ত সৈনিক হয়ে, সেই পুরাতন ভাঙা লন্ঠন আঁকড়েই, ফিরে যায় সেখানে। দুর্গাপুজোর নতুন জামা, ব্যকরণে ভুল দাঁড়ি,কমা, সস্তার লজেঞ্জুস,বরফকাঠি, মধ্যবিত্তের ধারবাকি, হ্যারিকেন,জোনাকির ঝিকিমিকি, গল্প শোনা খোকা খুকী। ভালোবাসা মোড়া লাল খাম, প্রথম প্রেমিকার ডাকনাম, তেলেভাজার গরম ঠোঙা, নদীর বুকে সঁজোড় ডোঙা। বারবার এরা খুব কাছে এসেও, চায় না দিতে ধরা, আসলে সেসব দিনগুলো ছিল, একটু বেশিই বাঁধনছাড়া। সেই ফিরে আসতেই হয় বাস্তবে আবার, ক্লান্ত ল্যাপটপের ওপারে থাকা, মোটা কালো চশমার ফ্রেমে লেগে থাকে, কিছু নাছোড়বান্দা সাদাকালো মুহুর্ত, আর একমুঠো রঙিন স্মৃতি।






দৃষ্টি থাকতো যদি

- লাবনী চক্রবর্তী
 
এখনো সারা গায়ে মাটি লেগে আছে। বুকে শ্যাওলা, ঊরুতে রক্তের দাগ! বাজার থেকে কিনে এনেছিলাম প্রসাধনী, আতর! লাল মাটির বেনারসী দিতেই যেন হাসি ফুটলো ঠোঁটে! পেতলের অলঙ্কারগুলো রং হয়নি এ বছর; অস্ত্র ধার দেবার লোক কই? একটু তাড়াতাড়ি ফিরছিলাম বাড়ি। কমিটি থেকে বায়না দিয়ে গেছে মূর্তিটার.. যাক! হাজার দশেক এলে শহর থেকেও ওষুধ আসবে। হাতে বাড়ির লক্ষ্মীর টগর ফুল... গোপালের তুলসী। রাস্তাটায় আলো ছিলোনা বটে... তবে ফুলের গন্ধ ছিল লোকে বলে - "দেবীপক্ষ"! তারপর এই বসে আছি ছেঁড়া জামায়.. সারা শরীরে ঘেন্নার ছাল! সামনের মেয়েটার একমেটে ফেটে চৌচির হয়ে গেছে ! চোখটা বড় ঝাপসা ঠেকে! তোকে লাল বেনারসী না পড়ালে, কোমরের ভাঁজে গোলাপী বিনা - ওরাও বুঝি চাইতোনা একটা 'ভাঙাচোরা' দূর্গা প্রতিমা! মা, আজ যদি সমস্ত প্রসাধনী পুড়িয়ে ফেলে- আগে এঁকে দিতাম ত্রিনয়ন, তবে আমারও অস্থি ঠিকরে বেরোতো অস্ত্রের রং! এমন লালচে রঙে ভয় হতনা আজীবন। এমন আঁশটে কামনায়- অন্তত বিকিয়ে যেতনা দুটো মেয়েই....!






সন্ধ্যার রঙ

- নৃপেন মন্ডল
 
পলাশের লাল একাকার হলে সারা প্রকৃতিময়, সূর্যের রক্তিম আভা হয় মোহময় - পশ্চিমের নীলের বাহার ফিকে হলে শোভা পায় ডোরাকাটা লাল। বনানীর সুরে শোক খুঁজে ফেরে, চেয়ে থাকে শৃগাল আকাশ পানে। ঈশান কোনের ন্যাড়া-ধুসর গাছগুলি, -যেমন চেয়েছিল ভরাট বিস্ময়ে! সন্যাসী গৌতম, -যুগান্তরে বিলীন আবছা আঁধারে। কিমবা আকাশের চোরাবালিতে সাদা বক। পাখ পাখালির ঘরে ফেরা শেষ হলে, কাকুলির সুরে যেন নিস্তব্ধতা কেটে যায়। সম্বিত ফিরে পেয়ে ন্যাড়া প্যাঁচা উড়ে আসে - মেঠো গাছে বসে। মৌমাছি নিষিক্ত ডিম্বাণুর খবর নিয়ে, চাকে ফিরে মধু খায়, ক্ষণিকের আলস্যতায়। দুরে গাছ গাছালির ভীড়ে 'কার্পাস গোড়া ' গ্রাম -শোভা পায় সন্ধ্যা আরতি প্রদীপ -শঙ্খ নিনাদ। যখন, ফুটে ওঠে রাতের তারারা দেখা দেখি, শীতল উষ্ণতায় অনাবিল সমস্ত আকাশ। আদুরে শুকতারার পিছু নেয় চাঁদ স্নিগ্ধ নদীজলে -ঝিকমিক, বর্ষাফড়িঙের শোকে গেছো চামচিকের উড়ে উড়ে করে ক্রন্দন -কিচমিচ। ক্ষণে ক্ষণে গাঢ় হলে আঁধার, জেগে ওঠে রাতের বিশ্বচরাচর -অপরূপ রুপ ।






হৃদয়বদল

- তড়িৎ দাস
 
সে বলেছে- আমার জন্যে ছাড়তে পারোনা তোমার নিত্যদিনের ক্ষুদ্র রাজ্যপাঠ? চলোনা হারিয়ে বহুদূরে, আরব সমুদ্দুরে আমি বললাম- বেশ। ইমন সাঁঝে দূর সাগরের নীল আঁখিতে তার দেখেছি ঝিলমিল। মেখেছি মন ভরে চাঁদের কণা ছুঁয়েছি তার তপ্ত দেহের সোনা। সে বলেছে- চোখ খুলবেনা কিন্তু, আমি মনটা আসছি সাগরজলে। পুরুষ-কণ্ঠের ফিসফিসানিতে, চোখ খুলে দেখি- চাঁদের আলোয়- ঐ দুজনের চলে যাওয়ার ছায়া।






জীবন নিরবধি

- পাভেল আমান
 
নিঃসঙ্গের কারাগারে বন্দি জীবন নিদারুণ দগ্ধতায় নিরন্তর খুঁজতে আছি উপশমের কেরামতি। অনুভূতির নিগূঢ় সূক্ষ্মাবকাশে ভরে গেছে যন্ত্রণার বিষাদ গাঁথা, প্রবাহমানতার বিপ্রতীপে ভাসমান জীবনের সহজাত সুস্থতা। অসহায় নিধিরাম সর্দারে অবতীর্ণ স্বকীয় সত্তার পরিচয় , দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে শান্তি স্বরূপ নিঃসঙ্গতায় ফেলে দিয়ে- একে একে স্বজন বিদায় যন্ত্রণার লহরীতে ক্রমশ আন্দোলিত মননের সুখের স্বরলিপি। তবুও তীব্র ধাক্কায় খুঁজেছি অন্য ভাবনার প্রতিবিধান যেখানে তাৎক্ষণিক ক্ষত নিরাময়ে- আবারো পুনরুজ্জীবিত জীবনের কামব্যাক নিঃসঙ্গের কারাগারেই অবলীলায় সহনশীলতার স্বাভাবিকতায় সৃষ্টি হবে, আর একটা নতুন প্রাণোচ্ছ্বাস ফিনিক্সের আগমনে ভাষা পাবে বন্দিত্বের শৃংখল মোচনে চিরন্তন স্বাধীনতা যার পরতে নবজীবনের স্বতঃস্ফূর্ততা।






বিরহ

- শিপ্রা পান্ডা
 
“দৃষ্ট” বলে ওকে দেখো , মন বলে না না দেখো না অশ্রু ঝরবে । “শ্রাবন” বলে ওর কথাগুলোই শোনো , মন বলে শুনো না তুমি ভেঙ্গে পড়বে। “বাহু” বলে ওকে জড়িয়ে ধরো, মন বলে যেওনা ব্যাথা পাবে। “চরণ” বলে ওর কাছে ছুটে চলে যাও, মন বলে না যেওনা কষ্ট পাবে। কিন্তু কখনো কখনো “মন-ও বলে যাও আটকে রাখবো না, ওকে ভালোবাসো……. তখন “আমি” বলি না আর যাবো না বিরহে থাকতে পারবো না”






একান্তে ব্যক্তিগত

- পল্লব মন্ডল
 
আমার যত প্রেম ছিল বা আছে তারা অদ্ভুতভাবে মিশে গেছে গাছের ফুলের সাথে কিংবা সবুজ পাতার সাথে ক্রমশ একটা গাছের জীবনে যার প্রত্যেকটা বছর বেড়ে গেছে মাটি থেকে বসন্তে পাতা ঝরার দূরত্ব! আমার আসা যাওয়ার মাঝে এক যাযাবর জীবন একটা আস্ত সবুজ ফুটবল মাঠে রাতের জোনাকিজ্বালা জাম গাছের আঁধার আর একটা শিউলি গাছ তার মাটিতে পড়ে থাকা সবকটা ফুল সবকটা গন্ধ সবকিছুই কি আমাদের প্রেম ছিল !






নিরুত্তর

- সৌরভ সিনহা
 
একাকীত্ব আর নিঃস্বঙ্গতা কি এক? কেন তাহলে পাশে অনেকে থাকলেও এক মনে হয়? নিজেকে কালপুরুষের কুকুরটার সাথে, তুলনা করতে ইচ্ছে হয়। চারিদিকে শূন্য, অন্ধকার শিকার করার মতো কিছুই নেই। যদি শিকার পেতামও, সেটাকে টুঁটি চিপে মারতাম না, কারন সেটাই তো আমাকে মুক্তি দেবে- এই একাকীত্ব থেকে। একাকীত্বের সাথে কিন্তু- তামাকের ধোঁয়ার সম্পর্ক খুব ভালো সাথে একটু বিরহ মিশিয়ে দিলে সেটা আরও রোমাঞ্চকর হয়ে যায় যেন ত্রিকোণ প্রেমের এক আদর্শ উদাহরণ। প্রেম মানেই কি নগ্নতা? -শরীরকে অনাবৃত না করলেও -মনের কাপড় তো খুলতেই হবে। যে ছেড়ে চলে গেছে সে আর ফিরবে না জানি, যদি অন্য কেউ আসে, সে কি আমার অধঃপড়া ফুসফুসে -কেমোথেরাপির কাজ করবে? নিঃসঙ্গতা হয়তো আর থাকবেনা, একা লাগাটা কি বন্ধ হবে? এসব ভাবতে ভাবতে -জীবনটাকে সপ্তর্ষির মতো মনে হয়, শুধুই প্রশ্ন । চাঁদটা হাসছে, সব উত্তর যে তার শরীরের -অতল খাদ্গুলোই লুকিয়ে আছে । ধ্রুবতারাটা দেখা যাচ্ছে না, সেও হয়তো এখন 'ড্যাফোডিলের' সৌন্দর্যে মগ্ন, কিন্তু তাহলে আমি দিক চিনব কেমন করে? কোনদিকে যাব? চারিদিকেই তো অন্ধকার!






সৃষ্টি

- শুভদীপ দত্ত
 
ছায়াপথের কালপুরুষের আত্মঘাতী সুর, পথ হারানো অন্ধকূপও আলোকবর্ষ দূর। বামন গ্রহের বেড়ে ওঠার যতই থাক ইচ্ছে, মহাকর্ষের হাত বাড়িয়ে কেউকি সাহস দিচ্ছে? যাযাবর ওই উল্কাটা পেলোনা আজও ঘর, ধূমকেতুর আলোকপুচ্ছই তার সহচর। অনন্ত এই মহাকাশের প্রতি কোনায় আশা, কত সৃষ্টি কত ধ্বংস,বেঁচে থাকার নেশা। অস্তিত্বের হাতছানিতেই মহাজগতের শুরু, সেই অস্তিত্বে প্রশ্ন করে এতই কি সে ভীরু? অস্তিত্বের শুরু যেখানে সেখানেই হবে শেষ, ধ্বংসপ্রাপ্ত তারকাতেই নতুন সৃষ্টির আবেশ। শরৎস্বচ্ছ আকাশতলে একলা ছাতে বসে, আকাশ জমিন চিন্তা আমার সৃষ্টি ভালোবেসে।



|| অণুগল্প ||






স্ত্রী

সেই মেয়েটা

- পম্পা খা


তারপর থেকে আর সবার সামনে সত্যি কথা বলার সাহস মেয়েটির হয়নি,দিনের পর দিন সেক্সচুয়াল হ্যারেসমেন্ট হওয়ার কথাটা প্রকাশ্যে আনার আগেই যেদিন দশ বছরের বাচ্চা মেয়েটির মুখ বন্ধ করে দিয়েছিল তার মা। সেই মুহূর্ত থেকে সে বুঝতে শিখেছে মুখ থাকলেও সব কথা বলার অধিকার তার নেই।
প্রতি রাত্রে স্ত্রীর মুখ থেকে মায়ের নিন্দা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়া ছেলেটাও একদিন এটাই মেনে নিতে বাধ্য হয় যে সব দোষ তার মায়ের।
স্কুল থেকে পালিয়ে যে মেয়েটা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তার কাছে এটা জলের মতো স্বচ্ছ, রোজ রাতে মদ্যপ অবস্থায় স্বামীর হাতে মার খেলেও স্বামীর কথায় শেষ কথা।
সায়েন্স নেবে না আর্টস সেটার সিদ্ধান্ত যদি পাড়াতুতো দাদা নেয় তাহলে জিবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়াটা খানিকটা জেগে ঘুমনোর মত হয়ে যাচ্ছে না??
লোকে কি বলবে সেই কথা ভেবে যেদিন তুমি পছন্দের পোশাক বদলাতে শিখেছ, সেদিন থেকে তুমি নিজেকে তুলে দিয়েছে অন্যের হাতে । কপালের দোষ দিতে দিতে ক্লান্তিতে ঘুমোতে যাওয়া ছেলেটা নিজের সাফল্যের পথটাকে কখন শক্ত শিকলে বেঁধে ফেলেছে সেটা বোঝার ক্ষমতা হয়ত আর নেই।
আর্থিক সচ্ছলতায় গরিব মানুষের পাশে দাঁড়াবে, শুধুমাত্র এই বাহানা দিয়ে আমরা আমাদের কে প্রতিমুহূর্তে গুটিয়ে নিই । নিজের দোষ ঢাকতে কখন যে নিজে ঢাকা পড়ে যাচ্ছি সেদিকে খেয়াল নেই আমাদের বিন্দুমাত্র, নিজের ভুল গুলো ধামা চাপা দিয়ে রাখতে রাখতে নিজের শিরদাঁড়া ভেঙে ফেলছি প্রতিনিয়ত।







পরিবর্তন

- আবীর মহাপাত্র


কি লিবে, ফলবিক্রেতা শুধাল -
এই দুটা আফেল, আর আদ ডজন কলা দিয়ে দাও, বলল শক্তিশালী চেহারার যুবক শ্রমিকটি।
রাস্তার অন্য পাশে চায়ের দোকানে বসে জয় এই দৃশ্য প্রায়ই দেখে।প্রথমবার যখন এটা দেখে, ওর মনে হয়েছিল, ছেলেবেলায় ও জানত শুধু শরীর খারাপ হলেই ডাক্তার ফল আর হেল্থ ড্রিঙ্ক খেতে দেয়।
এখন জয়দের বাড়িতে ফ্রিজে সবসময়ই ফল থাকে। সকালে বের করে ডাইনিং টেবিলে খাওয়ার জন্য সুদৃশ্য ঝুড়িতে তুলে রাখে নিপা, জয়ের স্ত্রী। কিন্তু বাচ্চারা সেগুলো দেখেও দেখেনা। পীড়াপীড়ি করাতে খায়। যেন মায়ের পেট ভরল, বলে নিপা।
জয় ব্যক্তিগত শিক্ষাদান করে, স্কুলের শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়েছে। মাসে রোজগার লাখ ছোঁয়। জয় নিপার এক ছেলে, এক মেয়ে। এখনো অনেকে বংশ রক্ষায় পুত্র সন্তান চায়। জয় ওর বৌকে বলেছিল, আমার কিন্তু মেয়ে হলে এক সন্তানই চলবে। না হলে, প্লিজ, দ্বিতীয় বারে না বলো না। দ্বিতীয় বারে ইচ্ছে পূরণ হল জয়ের।
জয়দের সময় গান বাজনা নাচ আঁকা এগুলো যেন বড়লোকদের ছেলেদের জন্যে ছিল। কোন স্যার যেমন ছোট খাটো শহরে ওইসব শেখাতেন না, বাচ্চাদের শেখানোর আগ্রহও যে বেশি লোকের ছিল, তাও না। এখন তো স্যার রা গ্রামেও যাচ্ছেন সপ্তাহে এক দু দিন করে। জয়রা যদিও ছেলে একটু বড় হতেই উঠে এসেছে শহরে। কিনেছে হারমোনিয়াম, ডুগি তবলা। ছেলে অনিককে ভর্তি করেছে ক্যারাটেতেও, আবৃত্তিও শিখতে যাচ্ছে। অনিক ক্লাস টুতে পড়ে। মেয়ের এই দ্বিতীয় জন্মদিন পালন করল। জয়দের সময় মেয়েদের আবার জন্মদিন পালন করাও চলত না। এখন সবাই এ নিয়ম ভাঙছে।
অতীতে বিচরণে ছেদ পড়ল বিল্টুর ডাকে৷ জয় দা, তোমার সাথে এখানেই দেখা হয়ে গেল, বলত ঘরে যাব, বৌদি, ভাইপো, ভাইঝি সব্বাই কে নিয়ে যেও কিন্তু, কদিন গ্রামেই থেকো, একেবারে ঘাট শ্রাদ্ধ বারভাত থেকে দাদুর কাজ ভালোয় ভালোয় শেষ করতে সাহায্য করতে হবে৷ জয় বলল, বাঃ বড় হয়ে গেছিস ত৷ বিল্টু টেনে পড়ে, বলল, বাবা শিখিয়ে পাঠিয়েছে৷ আর সেই পাড়া ভাগ নিয়ে কথাটার কিছু হল ? জয় জানতে চায়৷ আর বোল না, বিল্টু বলে, সবাই বলল, কাজ ঘরে পাড়া ছাড়াছাড়ি হোক৷ পুরো গ্রাম এখন তেমন অশৌচ পালেও না৷ খরচ ও কমবে৷ কিন্তু বাবা বলল, আমাকে তোমরা কাজটা ভালোয় ভালোয় করতে দাও৷ জানি তোমাদের পক্ষেই যুক্তি আছে৷ সবাই কে অনুরোধ, আমার বাবার কাজ, এতদিন যেমনটি হয়ে আসছে, হতে দাও৷ জানি অনেক কিছুর পরিবর্তন দরকার, পরিবর্তন হবেও, তবে আমাকে কষ্ট দিও না, আমার সে সাহস নাই৷
এরপর নীরবতা ভেঙে জয় বলে, ঠিক আছে, আমরা যাব৷ তিন দিন থেকে, পরিবেশনায় অংশ নিয়ে, খেয়ে - কাজ শেষ হওয়ার পরই ফিরব, কাকু কে আশ্বস্ত করে বলিস, আমিও শিখিয়ে দিলাম কিন্তু৷





|| আঞ্চলিক ||







সেকাল-একাল

- যক্ষরাজ
 
আড়ের পিড়ার শিমল তলে নুন-ড্যাঁড়া খেলছিল ছানা-পনা। ফাগুন্যা বিকাল যাব যাব করেও এখনও যায় নাই। তবে যাবেকেই , আর বেলা বেশি নাই। মাহাতদের খড় পালৈ দিয়ে ঘরে যাতে ছিল হোনা খাড়্যা। সারা দিনে তিন সের ধান, ভাত-মুঢ়ি সকাল বিকাল। এমন করেই দিন কাটত্যক, এখন আর গলা ঘরে কাম নাই। সবাই জমি-জমা ভাগে দিছে। যারা পারে, তারা চষে, যারা নাই তারা ভাগে দেয়। তাই সকাল হলেই ভাবতে হয় বসে বসে হোনাকে। এখন আর সেদিন নাই, কাজ-কাম ছাড়ে দিঁয়ে পাটি করে সবাই ‌ দলে থাকলে মাসে পঁদর কেজি চাল, মাগনা পাবি, বাকিটা ২টাকা কেজি। ইটা জঙ্গলমহল। কুথায় জঙ্গল দিকে দিকে সারাই মহল। পঞ্চুবাবুদের পাকাবাড়ি, দালান-ঘর। সনাতনের বাপ আমার সঙ্গেই মান্দার খাটেছে কত বছর এখন তার বেটা মেম্বর। ঘর-বাড়ি গুছাঁই লিলেক। দিদি বলে মা-মাটির সরকার সব মিছা, সব পেঁদা কথা যেই যাছে লঙ্কায়, সেই হছে রাবণ। গাঁয়ের রাজা রাবণ, কলকাতার সীতা হঁয়ে তুঁই কি করবি বল ?






ভঁন্দু খুড়ার বহাল আইড়ে

- রাজীব লোচন মাহাত
 
ভঁন্দু খুড়ার বহাল আইড়ে ভইরে গেছে কাশ ফুলে আগে দেইখেছিলি আড়ে-উড়ে সেদিন যাতে ছিলি আইড় ধইরে হামার চৈখ দাঁড়ায় গেল হে! সাদা ফুলে ভিড় লাইগেছে.. হাওয়া দিলে ঠেলা আর ঠেলি যেধারে থানাহাছি সবুজ ও সবুজ। উপরটাই বুঁন্দলা বুঁন্দলা মেঘ কি জুতের দেখাই! ও হো..হো..হো এখন যদি মোবাইলটা হানথি ত সেলফি টা তুলেই লিথি সেটাও হইল নাই ।






পরব দিনে

- রাজীব লোচন মাহাত
 
পরব দিনে মেলায় গেলি কত রকম যে দেইখে আলি.. দকানে দকানে ঠাসা ঝিল্পি-লাড্ডু-মিষ্টি-গজা রকমে রকমে কত কি গো। কেউ সাইজেছে লালে...বঁধু হলুদ-সাদা-লীলে কেউ বাঁইধেছে মাথায় খপা নানা রকম ফুলে। নাকেতে নাকফুল পরে কানে দুলে দুল গো। হামার বঁধু ছিঁড়া জামাতে মাতায় সেম্ফুকরা চুইল গো। চুমকি বাতির চম্ চমানি বিজলি বাতির ঝলক তকে দেইখে হামার ...ওগো চৈখে পড়েনাই পলক। হামরা রঙে রঙে সঙে সঙে রীঝে মাতি কত ঢঙে বঁধু সে কিকইরে বুঝাব তকে গো।






ঝাড়খণ্ডি রিজের ছৌ

- যক্ষরাজ


ঢোলে চাটি পড়েছে তখন ,"খেখে তাখ্ তেরে কেটে তাক , ধমসা ঝাঁ গুড় গুড় গুড় ... ..... " শ্রীমন্ত্যা মাঝির গলা --- "সিন্দুরের বিন্দু বিন্দু মুষিকবাহন ----"
হর-গৌরী নন্দনের বন্দনা শুনেই বিমল খুড়া ঝাঁপাই উঠল্য, বল্যল হেই পচা ভাইপ চল ছৌনাচ দেখে আসি। রাণীবাঁধ ব্লক অফিসের বিডিও বাবু বড় রসিক মানুষ বটে, ছৌ,ড্যাঁর,টুসু,ভাদু সবেই হুচুক আছে লোকটার। তখন রাইত আটটা হবেক। গরা মাহাত,বাঁকা মাঝি,মেঘা সদ্দার , মিঞা জল্যা কে সঙে নিয়ে সাইকেলে বাইরাই গেলম। খাওয়া আর হল্য নাই, সময় নাই মুড়ি সেরা দশেক গামছা গাঁঠাই নিয়েছে বিমল কাকা। শালার মুঢ়িটাই জীবন। রুদড়ার সত্যেনবাবুর ছটবেটার দকানে পঁচা আলুর তিন টাকার তিনগণ্ডা চপ লিতে ভুলে নাই শালা‌ । দেউলির জোড়ে বসে গেল জোসনা রাত্যে ‌। খাঁইয়ে লিয়ে দক্তাটা থাসে মুখে পুরে সাইকেলে উঠল, নামল্য রাণীবাঁধ কালীতলায়।
চপ্পর-রাইত ছৌনাছ।
মেলা দল ।
সেকি নাচ রে বাপ। নাচে ধূলা উড়াই দিতে থাকে গণেশ,কাত্তিক,মহীরাবণ,মৈষাশুর,কিচক,কিরাত, অর্জুন, অভিমন্যু। বুধা মাহাত উত্তরা সাজে সে নাচটা নাচেছিল বাপ, সেকি বলব্য। নিতা মাঝি দৌপদী, বাবারে বাবা বস্ত্রহরণের কাপড় শেষেই হয় নাই, শালগাছের ট্যাঁঙে রাখা কাপড় কি বাপ শেষ হয় ?
মৈষাশুরের ডিগবাজি, উল্টাপাল্টা,আগল্যা-পিছল্যা কত দেখবি বাপ্। হেই মানুষ গিল্যান যে সারাদিন একশ দিনের কামে বাঁধের মাটি কাটেছিল,সকাল হলেই মাটি কাটতে যাবেক বুঝাই যায় নাই। বুধা মাহাত বলত্যেছিল কাম-কাজ ত আছেই, কত্যেই হবেক নাইত বাঁচব কিসে, তাই বলে রিজটাকে মরাই দিতে ত পাইরব্য নাই। রাতে নাচে দিনে খাটে এমনি করেই ত হামদের বাপ্ ঠাকুরদাদারা বাঁচেছিল, আমরাও বাঁচব্য‌ । তাও রুখামাটির মানুষ গুল্যানকে আনন্দ দিতে ছাড়ব নাই।।





|| প্রবন্ধ ||







অভিজ্ঞতা

- ডঃ সঙ্গীতা নায়ার


আমি পেশায় ডাক্তার । প্রায় তিরিশ বছর ডাক্তারি করছি । এই গল্প লিখতে বসে যে বিষয়টা আমি রোজ চর্চা করি তার থেকে ভাল গল্প আর কি বা হতে পারে ? তাই আজ আমার জীবনের কিছু অভিজ্ঞতাই আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেব।
মেডিকেল কলেজে শিখে এসেছি রোগীর ইতিহাস শুনেই ৯০% রোগ নির্ণয় করা যায় – তাই শুরুতেই জিজ্ঞাসা করলাম – কি অসুবিধা বলুন ? উত্তর এলো – “ তুই ডাক্তার , তুই বল আমার কি হয়েছে । বুড়ি, আমি কি জানি ? ”
বললাম – “ আহা , কোন জায়গায় কষ্ট বলো দিদি – মাথা ব্যাথা , হজম হচ্ছে না , ঘুমের সমস্যা, কিছু তো বলো । " তবেই না রোগটা ভালো ভাবে বুঝব । এতো দেখছি উল্টো পুরান – ঠিক করলাম পুরোনো শিক্ষা ছেড়ে নতুন করে ডাক্তারী শিখতে হবে আবার । কিছু রোগীকে নিয়ে আরও মুশকিল – কি হয়েছে শুধালে উত্তর আসে সুগার আছে ,প্রেশার আছে, হাঁটুতে বাত – আরে এতো দেখছি নিজেই ডাক্তার – তাহলে আর আমার কাছে আসা কেন? আবার কেও কেও ইতিহাস বলে , শরীর দেখিয়ে , prescription করে দরজা থেকে ফিরে আসে – তার মূল সমস্যা নাকি তখনই মনে পড়েছে। অগত্যা prescription cancel, নতুন করে আবার লেখো ।কলেজে কেউ শেখায়নি যে যাদের চিকিৎসা করবো , তাদের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি , নিজেদের সমস্যা অন্যের কাছে ব্যক্ত করার ভাষাই তাদের নেই ।
পরের সমস্যা আরও গভীর - prescription হাতে নিয়েই প্রশ্ন- কি কি বাতুল? বলি সুস্থ থাকতে গেলে ভালো খাবার খুব প্রয়োজন । তাই যা রুচি হয় তাই খাবেন – একটু প্রোটিন খাবার – মাছ/মাংস/ডিম/দুধ/জল/সয়াবিন- “ওমা ডাক্তার বাবু সে সব তো কবেই বিসর্জন দিয়েছি, রোগ হবার পর শুধুই শাক-ভাত-পেঁপে সেদ্ধ খেয়ে আছি।” কলা পাকা খেলে ঠান্ডা লাগে ,টক দই খেলেও তাই, মুড়ি খেলে পাতলা পায়খানা হয় – এই সকল ধারনার সঙ্গে আমার নিত্য লড়াই – তবে হ্যাঁ স্বীকার করছি, কচ্ছপের রেসের মত একটু একটু করে জিতছি । আবার উল্টোটাও সত্যি । কিছু পরিবারে মাছ - মাংসের চল খুব বেশী , সবজী প্রায় খায় না – আগের তুলনায় হাই প্রেশার । হার্টের সমস্যা , কোলেস্টেরল অধিক মাত্রায় থাকা – এই সব রোগ গ্রামে খুব বাড়তে থাকছে ।
একদিন আমার গ্রামের সম্পর্কে এক নাতনী প্রশ্ন করল “দিদা চূলে তুমি কী লাগাও , এতো কালো হল কী করে?” বলি ওরে আমার চূলের রঙটাই ওই রকম । সে তো বিশ্বাস করে না – তখন তাকে জেরা করে জানালাম খুব ছোট বয়স থেকে এরা চুলে বাজার থেকে আনা কলপ লাগায় , চুল লাল হওয়া যে প্রোটিন , ভিটামিন খাদ্যের অভাবের জন্য তা তারা জানেই না । আবার এক ICDS দিদিমণি হাজির হলেন মুখে র‍্যাশ নিয়ে, তিনি নাকি বছর বছর ধরে মুখে BETNOVATE C লাগান । এবং তিনি একা নন , গ্রামের সকল বয়সের মেয়েরাই স্টেরয়ড ক্রিম লাগায় রঙ ফর্সা হওয়ার আশায় – আমার চোখ তো ছানাবড়া । রসকুন্ডের জলে ডুব দিলে বাত সারে , মাদুলী ধারণ করলে বাচ্চা কোলে আসবে , টোটকা ঔষধ খাইয়ে স্বামীকে বশ করা যাবে – কত অবৈজ্ঞানিক চিন্তা ধারার সঙ্গে এখনো প্রতিদিন সম্মুখীন হই আমি – অথচ কোনোটাই ঠিক নয় ।
খাতড়া-রাণীবাঁধের বুকে আজ অনেক বছর কেটে গেল- কিছু খারাপ স্মৃতি মনে খুব ভীড় করে। ছোট্টো সাগেনের মাদাল বীজ গলায় আটকে আমার হাতেই মারাগেল , সারা রাত সন্তান হারানো মায়ের আর্তনাদ আমি আজও ভুলতে পারিনি। ঝিলিমিলির নাম অজানা শিশু কন্যা শীতের রাতে কালাচের কামড়ে প্রাণ দিল তখন তার বাবা মা কে সন্তান দেবার মত সাহস পাইনি। দুঃখের এই স্মৃতি গুলো আজও রাতে জাগিয়ে রাখে। তবে তার পাশাপাশি অঙ্কিতার ম্যাডাম মাসিমনির জন্য ফুল নিয়ে আসা, চয়নিকার স্বরস্বতী পূজোর প্রসাদ খাওয়ানো এই সব মধুর স্মৃতি ও ঘুরে ফিরে আসে।
তবে করোনা মহামারী আজকের সমাজে বিরাট পরিবর্তন এনেছে । মানুষের মনে যত সংকীর্ণতা প্রকট ভাবে সামনে চলে এসেছে । মহামারি শুরু থেকেই হাসপাতাল গুলো প্রায় বন্ধের মুখে , প্রাইভেট চেম্বারও বন্ধ । তাই ঠিক করলাম কপালে যা হয় হোক – এই সময় আমার রোগীর পাশ থেকে সরে যাওয়া ঠিক হবে না । চেম্বার চলতে থাকল সবরকম সাবধানতা বজায় রেখে । কিছু দিন আগে জ্বর সর্দিকাশির কবলে পড়লাম –ছুটি নিলাম । করোনা টেস্ট নেগেটিভ এলো । কত লোকের কত কটূক্তি – ম্যাডামের করোনা হয়েছে ,উনি লুকোচ্ছেন, অর্থ উপার্জনের জন্যই আজ রোগে পড়তে হলো – এতে যে আমি ব্যাথা পাইনি এটা বলা যাবে না । তবে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতেই খোঁজ, কবে রোগী দেখা শুরু করব আবার। তারই মধ্য ছোটো শিশুরা খোঁজ নিলো দিদি কেমন আছে । কেউবা দিদিকে দুধ পৌঁছে দিচ্ছে । মানুষের মধ্যে বেশীর ভাগটাই ভাল এই বিশ্বাস নিয়ে বাঁচতে ইচ্ছে করে। কর্মই ধর্ম এই ভাবনা এগিয়ে যাওয়ার সাহস দেয়।
তবে সুস্থতা এবং স্বাস্থ্য কোনো একক বিষয় নয় । পরিবেশ সচেতনতা , কৃষি উৎপাদন বাড়ানো , শরীর চর্চা উপযুক্ত ব্যায়াম , নিজেকে এবং বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখা এবং সর্বোপরি মনের উদারতা বাড়ানো এই সবই সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে । তাই আসুন না সকলে মিলে হাত ধরাধরি করে সমাজকে নতুন দিশা দেখাই।
আর টিম নিঃস্বার্থের ডাকাবুকো ভাই-বোনেদের পাশে পেলে এই কাজ খুব সহজ হবে বলেই আমার বিশ্বাস । সুশিক্ষাই একমাত্র সমাজ পাল্টানোর হাতিয়ার।







উপলব্ধি

- আশীষ ঘোষ


বিপদ যতক্ষণ না আমাদের দরজায় এসে কড়া নাড়ে, সচরাচর আমরা পূর্বানুমানের ভিত্তিতে সচেতন হই না। কারণ আমরা নিজেদের কাজে -অকাজে এত ব্যস্ত রাখি যে, কোন বিষয় নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে ভুলেই গেছি। অথচ প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা যাদের আমরা আমাদের তুলনায় নিকৃষ্ট বলে মনে করি, তাদের অনুমান শক্তি বা অনুভূতি এতই প্রবল নিজেদের রক্ষা করার জন্য অগ্রিম ব্যবস্থা গ্রহণ করে তারা। তারা দলবদ্ধভাবে একে অন্যের পাশে থাকে সর্বদা।আমাদের অপরিণামদর্শিতা, অনমনীয় মনোভাব, অহংকার, অত্যধিক আস্থা, আস্ফালন, অবহেলা, অসংযমী জীবনযাত্রা নিয়ে এসে দাঁড় করায় জীবন মৃত্যুর প্রান্ত সীমায়। এছাড়া রাষ্ট্রনেতাদের ক্ষমতা প্রদর্শনের নামে অসহনীয় অসাম্য প্রতিযোগিতার ফলস্বরূপ সমগ্র দেশ ও জাতির জীবনে নেমে আসে গাঢ় অন্ধকার। বর্তমানে সমগ্ৰ বিশ্ব এক অদৃশ্য বিপদের মুখোমুখি। এই মহা সংকটে মানুষ নেই মানুষের পাশে।
একসময় 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে'-এই ছিল বাঙালির প্রত্যাশিত জীবনধারণের মান। সময়ের ফেরে, উন্নয়নের জেরে আমাদের ধ্যান ধারণায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। একান্নবর্তী পরিবার ছেড়ে,অণু পরিবার গড়ে বাঙালি এখন আত্মসুখ সন্ধানে নিমগ্ন। হাতে পেল্লাই সাইজের ট্যাব , অ্যানড্রয়েড সেট নিয়ে Book থেকে মুখ ফিরিয়ে মগ্ন এখন ফেসবুকে। লাইক ও কমেন্টের বন্যায় ভেসে যাওয়া। আন্তর্জাতিক সংযোগ ব্যবস্থার কল্যাণে জীবন এখন গতিময়, বেপরোয়া। সাহিত্য বাসর থেকে শ্রাদ্ধবাসর সবই এখন ফেসবুক। পৃথিবীর সমস্ত সুখ যেন হাতের মুঠোয়। অনুকরণ প্রিয় বাঙালির চুলে উঠেছে কৃত্রিম রং। দামী পোশাকের অনুকরণে স্বল্পতার ছাপ, এক কথায় জীবন ধারণের মানে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। যা বাংলা ও বাঙালির ঐতিহ্য সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই নয়। সভ্যতার গতিধারায় জীবন যাত্রার মান পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু লোক শিক্ষক রামকৃষ্ণ, মা সারদা, স্বামী বিবেকানন্দ, বিদ্যাসাগরের শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে বড় হয়ে বাঙালি যখন দেশ ও দশের কল্যাণের কথা বিস্মৃত হয়ে স্বার্থপর জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে তখন তাকে জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন বলা কষ্টকর। জীবনে ত্যাগ, মমতা, মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিক দায়িত্ব বর্তমান জীবনযাত্রায় অনুপস্থিত।
ভোগ্য পণ্যের চাহিদা দ্বারা চালিত, রক্তমাংসের আনন্দবোধ এর দ্বারা তাড়িত, তাদের দৃষ্টি ভঙ্গিতে সমগ্ৰ পৃথিবীটাই যন্ত্র বিশেষ, জড় পদার্থ দিয়ে তৈরি, শারীরিক প্রয়োজনে যারা চলে তারা ন্যায়বন্টন,সমতা ও স্থিতিশীল উন্নয়ন নিয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন। তাদের জীবনধারা যেসব মূল্যবোধ এবং মৌল শক্তির দ্বারা নির্ধারিত হয় তার কোনো পরিবর্তন হয়নি।কিন্তু ভারতের ঐতিহ্য ও পরম্পরা হল জীবনকে শুধুমাত্র বৈষয়িক সাফল্যের মাপকাঠি তে না দেখে সামগ্রিক গুণাবলীর নিরিখে তার মূল্যায়ন করা। একজন গরীব মানুষ সৎ হলে তার যে উন্নতি ঘটে একজন অসৎ ধনী কখনোই তা পারে না। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যে আত্মমর্যাদাহীন, স্বার্থপর আপোষ লক্ষ্য করা যায় তা আমাদের অর্থের বিচারে ধনী করলেও জীবনের উন্নয়নের ধারে কাছে পৌছাতে পারেনা।
অতীতে আমাদের দেশ রাজনৈতিক,সাংস্কৃতিক ও সাংগঠনিক উৎকর্ষতার চরম শিখরে অবস্থান করে যে সুনাম অর্জন করেছিল তা আজ ভূলুণ্ঠিত।বর্তমানে সর্বত্র যে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ লক্ষ্যনীয় তার অন্যতম কারণ সমাজ পরিচালনার দায়িত্বে নিম্ন ও মধ্য মেধার অস্তিত্ব। প্রত্যেকে জনকল্যাণের নামে নিজের আখের গোছাতেই ব্যস্ত। নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য দেশের ঐতিহ্য পরম্পরা ধর্মকে নিজেদের মত করে ব্যাখ্যা দিয়ে জনসাধারণকে বিপথে চালিত করতেও দ্বিধা করে না।
আজ থেকে দুশো বছর আগে এই বাংলার মাটিতে জন্ম নিয়েছিলেন পরমপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। নানাবিধ গুণের একত্র সমাবেশ বিদ্যাসাগরের মধ্যে একাধারে ভারতীয় ঋষির জ্ঞান অপরদিকে ইংরেজদের মত কর্মোদ্দীপনা। দয়া,মায়া, প্রেম, বীর্যের অধিকারী বাঙালির জীবনে মহীরুহের মতো ছায়া প্রদান করেছেন। তাঁর দৃঢ়চেতা মনের বিকাশে হীনমন্য বাঙালি নতুন ভাবে বাঁচার অক্সিজেন পেয়েছিলেন। দারিদ্র্যের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে কর্মনিষ্ঠা ও আত্মবিশ্বাসের জোরে ব্যক্তিত্বশালী বিদ্যাসাগর শিখিয়ে ছিলেন পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার মন্ত্র। দূরদর্শী বিদ্যাসাগর উপলব্ধি করেছিলেন সমাজে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা অশিক্ষা ও কুসংস্কার গুলি সমাজ প্রগতির অন্যতম বাধা। তাঁর কর্মে ও ব্যবহারে কোনদিন দ্বিচারিতা দেখা যায়নি। যা সমগ্র ভারতবর্ষে বর্তমানে এক বড় অসুখ। বর্তমানে আমরা যা অন্যকে করতে বলি তা নিজে করি না। শিশু শ্রম, অশিক্ষা, দারিদ্র্য,নারীর অসম্মান, বেকারত্ব আজও বিদ্যমান।স্বচ্ছ ভারত বা ডিজিটাল ইন্ডিয়া কেবল স্বপ্ন।
সময় এসেছে উপলব্ধির, আত্ম বিশ্লেষণের,আত্ম মূল্যায়নের,নিজের অধিকার সম্পর্কে যেমন সচেতন থাকতে হবে, তেমনি নিজের দায়িত্ব কর্তব্য পালনেরও হতে হবে সচেষ্ট। একজন আদর্শ শিক্ষক মূল্যবোধের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে গড়ে তুলতে পারেন এমন এক ছাত্র ও যুব সমাজ যারা আগামী দিনে হয়ে উঠবে সমাজ জীবনের কান্ডারী।সেখানে থাকবে না পুঁথি সর্বস্ব পেট চালানোর বিদ্যার অনুশীলন।সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নেতৃত্ব, সহানুভূতি,সমানুভূতি ও নান্দনিক বোধের জাগরণ ঘটানোই হবে প্রকৃত শিক্ষাদান। অন্তর প্রেরণা জাগ্রত করে গড়ে তুলতে হবে নীতিবোধ ও মানবিক মূল্যবোধের নতুন জীবন পরিকল্পনা। রক্ষা পাবে দেশ, সুরক্ষিত হবে নিজেদের জীবন।





|| জাগো দূর্গা ||







প্রকৃতির রূপ

- শুভম মল্লিক


চারিদিকে স্তব্ধ,নিশ্চুপ। আজ মানুষ কাঁদছে কিন্তু প্রকৃতি হাসছে, পাখিরা আজ শুদ্ধ বাতাসে নিজেকে মেলে ধরছে। যে মানুষ গুলো আনাগোনা, ভিড় দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল তারা আজ বাড়িতে বন্দি হয়ে নীল আকাশ, বাতাসে নিজেকে রাঙিয়ে দিয়েছে। শুধু গরিব মানুষ গুলো নিজেদের অন্নের জন্য কাঁদছে, তারা এই পরিবেশের ছবি টা মন থেকে মেনে নিতে পারছে না, আবার কবে স্বাভাবিক হবে সব কিছু জানি না? হয়তো কিছু দিন পর সব আগের মতো হয়ে যাবে, পরিবেশ টা আবার দূষণে ভরে যাবে, গাড়ির শব্দে পাখির গলার স্বর শুনতে পাবো না হয়তো, নিজেকে ঘরে বন্দি রাখার কষ্ট টা দূর হয়ে যাবে আবার এক পড়ন্ত বিকেলে বন্ধুর হাত ধরে খেলতে যাবো, চাষীরা জমিতে চাষ করতে যাবে, সবাই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যাবে। একটা ভাইরাস বাড়ির সমস্ত লোক গুলোকে এক করেছে, আবার কিছু মানুষের মুখ থেকে খাবার কেড়ে নিয়েছে, কত প্রিয়জন তাদের ভালোবাসার মানুষ গুলো কে হারিয়ে ফেলেছে, কতদিন মন্দির এর পুজোর শব্দ শুনতে পায়নি, মন্দির এর ভগবান কতদিন উপোস করে আছে,দেশে রাজনীতির মুখ গুলো আজ হারিয়ে গেছে। ধর্ম,জাতি,গরিব,বড়লোক সবার আজ একটাই পরিচয় আমরা রক্ত মাংসর মানুষ। কিসের এত হিংসা, ক্রোধ? তাই সবাই মিলে একটা নতুন পৃথিবী গড়ে তুলি নতুন প্রজন্মের জন্য।মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন ঘুরছে আজ কেন কোনো মানুষ মন্দির,মসজিদ গির্জা তে গিয়ে পুজো দিচ্ছে না? কেন তাদের ভগবান সব ঠিক করে দিচ্ছে না? সত্যি জানি না!
  সবাই ভালো থাকুক, সবাই যেন নিজেদের ছন্দে ফিরে আসে, সবাই সুস্থ থাকুক, শহরের ভিড় গুলোর মধ্যে আবার নতুন ভালোবাসা গুলো খুঁজে পাক।







করোনা মুক্তি

- নীলাঞ্জন পাত্র


1st সেপ্টেম্বর রাতে ঘুমোতে যাবার সময় নীলাঞ্জনের হালকা হালকা গলা ব্যথা শুরু হয়। ও ওটা নিয়ে বেশি না ভেবে ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন সকালে উঠে দেখে ওর মায়ের ভীষন জ্বর। ওর মা মুখে mask পরে শুয়ে রয়েছেন । করোনার ভয়ে বাড়িসুদ্ধ লোকজন আতঙ্কিত । নীলাঞ্জন ভাবল , হয়তো ওর মায়ের সাধারন সর্দি কাশি হয়েছে তাই এ বিষয়ে নিয়ে সে খুব একটা চিন্তিত ছিল না , কিন্তু ঘটনা ঘটতে শুরু করে দুপুর থেকে । দুপুর প্রায় ১ টা থেকে নীলাঞ্জনেরও জ্বর আসতে শুরু করে । মা ও ছেলের জ্বর দেখে বাড়ির লোকজন অর্থাৎ নীলাঞ্জনের কাকু, কাকিমা, দাদু, দিদা, উপরে দোতালায় উঠে যায়, নীচের তলায় খুব প্রয়োজন হলেই নেমে আসতো, নয়তো নামতোই না, তবে প্রতিদিন ৩ টে প্যারাসিটামল চার্জ করার দুদিনের মধ্যে দুজনেরই জ্বর কমে আসে । মামা, মেসো, বন্ধু, টিচার্স ও অন্যান্য আত্মীয় পরিজনরা ওদের আশ্বাস দিতে থাকে এবং ৫ টা, azithromycin antibiotics সাথে gas এর ওষুধ, মাল্টিভিটামিন ও vitamin C খেতে বলে আর খেতে বলে প্রোটিন যুক্ত diet, কিন্তু প্রোটিন যুক্ত খাবার বানাবে কে? করোনা হয়েছে শুনে সবাই বাড়ির দোতালায় উঠে যায়, কেউ রান্না করতে চায় না,অগত্যা তাদের দুজনের খাবার বলতে মুড়ি ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। নীলাঞ্জনে ছোটো ভাই রয়েছে , তাই নীলাঞ্জনের বাবার পক্ষেও একা হাতে স্ত্রী ও দুই ছেলেকে সামলানো খুব কষ্টের হয়ে ওঠে , তাও তিনি তার সাধ্যমতো চেষ্টা ধরে রেখে নিয়মিত গরম জল , লেবু, ফল, ছানা, ডিম সেদ্ধ দেবার চেষ্টা করে গেছেন একা হাতে , কিন্তু এরকম ভাবে একা হাতে সবকিছু সামলানো এক দিন বা দুই দিনের জন্য সম্ভব... দীর্ঘ ১৪ দিনের জন্য একদমই নয় । তাছাড়া ওদের বাড়িতে একটিই বাথরুম । তাই বাড়িতে ওরা থাকলে বাড়ির অন্যদের সংক্রমন হবার প্রবণতা রয়েছে , কিন্তু তখনও ওরা নিশ্চিত নয় যে, ওদের করোনা হয়েছে কিনা । নিশ্চিত হবার জন্য ওরা ৭ই সেপ্টেম্বর খাতড়া হাসপাতালে টেস্ট করায় , তাতে নীলাঞ্জনের বাবা ও ভাই এর আসে নেগেটিভ আসে কিন্তু নীলাঞ্জন ও তার মায়ের আসে পজেটিভ । হাসপাতাল থেকে ওদের দুজনকে খাড়িডুংরি নামক সেফ কোয়ারেন্টাইন হোমে পাঠানোর জন্য বলে । কিন্তু নীলাঞ্জনের বাবা চেয়েছিলেন সমস্ত নিয়ম অবলম্বন করে বাড়িতেই রাখতে , তাই তিনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে হোম কোয়ারেন্টাইন এ রাখার জন্য আবেদন করেন , সেই আবেদন কর্তৃপক্ষ মেনে নেয় । কিন্তু বিচিত্র এই জগৎ সংসার । নীলাঞ্জনের বাবা চাইলেও ঘরের বাকি সদস্যরা যদি সহায়তা না করে তাহলে হোম কোয়ারেন্টাইন কোনোমতেই সম্ভব নয়। সেদিন হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরে, সন্ধ্যা , রাত এবং তার পরের দিন সকাল এই তিন বেলার খাবার হয় “মুড়ি” । করোনা হয়েছে শুনে নীলাঞ্জনের কাকিমা রান্না করতে রাজি নয় । একদিকে খাবারের অভাব, অন্যদিকে attached বাথরুম সাথে পরিবারের নো সাপোর্ট আর নীলাঞ্জনের বাবার একা হাতে সব সামলানোর অসুবিধে এই সব কিছু মিলিয়ে নীলাঞ্জন ও তার মা সিদ্ধান্ত নেয় কোয়ারেন্টাইন হোমে এ গিয়ে থাকার । ওদের সিদ্ধান্তকে ওর মামা, মেসো, বন্ধু ও অন্যান্য আত্মীয় পরিজনরাও সাপোর্ট করে । অবশেষে ৮ই সেপ্টেম্বর রাতে ওরা দুজনে খাড়িড়ুংরি সেফ হোম এ গিয়ে পৌছায় ।
চারিদিকে পাহাড় ও গাছ গাছালিতে ঘেরা মুকুটমনিপুরের পাশের অঞ্চলেই হল খাড়িডুংরি , ৮ই সেপ্টেম্বর রাতে পৌঁছে নীলাঞ্জন একটু নার্ভাস ছিলো, কারন এটা হচ্ছে সেফ হোম , এখানে শুধু খাবার ও ভিটামিন দেবে। কোনো ডাক্তার বা নার্স নেই , বারবার অক্সিজেন মাপার ব্যবস্থা নেই। কিন্তু ওখানকার মানুষ তাকে খুব মেন্টাল সাপোর্ট দেয় । আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে অনেক জনের সাথেই পরিচয় গড়ে ওঠে, বেশ কিছু নতুন বন্ধুও হয়ে যায় খুব কম দিনের মধ্যেই । ফোনে সব প্রিয় মানুষজন দের সাথে কথা বার্তা চলতে চলতে দিন গুলো বেশ কাটতে থাকে । সকাল ৯টায় ব্রেকফাস্ট , ৪টি পাউরুটি , একটা কলা , একটা ডিম সেদ্ধ আর এক গ্লাস গরম দুধ। তারপর ১০:৩০ নাগাদ তিনজন হেলথ ওয়ার্কার এসে টেম্পারেচার ও অক্সিজেন মাপত সাথে দিত ভিটামিন বি কমপ্লেক্স দুপুরে খাবার জন্য। দুপুর ২টায় লাঞ্চ, ভাত, ডাল , আলু-ভাজা , একটা তরকারি , সাথে মাছ বা মাংস ।
রাত ৯ টায় ৫ পিস রুটি , একটা তরকারি আর ডিম, ভরপুর প্রোটিন যা নীলাঞ্জনের বাড়ির লোক কোনোদিনই তাকে দেয়নি , আর ভবিষ্যতেও দেবে না। ওরা মেডিসিন বলতে ভিটামিন বি , ভিটামিন সি ,আর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট দিত , আস্তে আস্তে ওদের শরীরের উন্নতি হতে থাকে । কফ, কাশির পরিমান কমতে থাকে , হাঁপানিও কমতে থাকে । বাবা,মা,মামা,মাসিমেসো,মামাদাদু,মামাঘরের সমস্ত আত্মীয় পরিজন, বন্ধু বান্ধব , দাদা ,দিদি ও অন্যান্য আত্মীয় পরিজন ও টিচার্স দের ভালোবাসায় ১০ দিন পর ওরা মোটামুটি সুস্থ হয়ে ওঠে এবং ওদেরকে ১৭ই সেপ্টেম্বর ,মহালয়ার দিন রাতে ওখান থেকে ছেড়ে দেয়।
এখন ওরা সুস্থ আছে ।
তো আপনাদের উদ্দেশ্যে দুটি বার্তা –
১) করোনা হলে বেশি ভয় পাবেন না ,যদি শ্বাসকষ্ট না হয় তাহলে কোনো ভয় নেই , প্রোটিন যুক্ত খাবার , ভিটামিন , গরম জল , লেবু , ফল এসব খান। ইমিউনিটি বাড়বে আর পালস অক্সিমেটস এ চেক করে দেখুন অক্সিজেন লেভেল কত আছে, যদি অক্সিজেন লেভেল ৯৪ এর নীচে নেমে যায় তখন ইমিডিয়েটলি হাসপাতালে ভর্তি হন ও ডাক্তারের এর সাথে কনসাল্ট করুন ।
২) করোনা পেশেন্টদের আলাদা থাকতে বলা হয় , আলাদা রাখতে নয়। তাই প্লিজ এই সময় করোনা পেশেন্টদের সাপোর্ট করুন নিশ্চয়ই সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই হেল্প করুন, দয়া করে ওদের মুড়ি খেতে বলে একা দূরে সরিয়ে রাখবেন না ।








সিরিয়াল কিলার

- তনুশ্রী হাঁসদা


স্যার আমার অনেক দিনের ইচ্ছে গ্রাম বাংলা নিয়ে সিরিয়াল করব, যেখানে নিম্নবর্গের কথা থাকবে।
'তা সে আর এমন কি জটিল কথা' মনোময় স্যার পান চিবুতে চিবুতে বললেন।
তবু স্যার যদি একটু বুঝিয়ে বলেন।
বুঝিয়ে? আচ্ছা শোন তুই গল্পের প্লট নিয়ে যা বীরভূমে, না না বীরভূম নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে। তুই চলে যা শাল ,পলাশের জঙ্গলে, বাঁকুড়া পুরুলিয়াতে।
আমি পুরোদমে স্যারের পরামর্শ লিখে চলেছি।
তারপর স্যার?
তারপর আর কি, কিছু চরিত্র নে, তাদের মধ্যে জংলী ভাব, বোকা ক্যাবলা ভাব মিশিয়ে দে। আর হ্যাঁ গায়ের রংটা বাপু কয়লার মতো কালো করিস। আঁটো সাঁটো শাড়ি পরা ব্লাউজ বিহীন মেয়ে চরিত্র নিয়ে আন। আরে হাঁ করে কি তাকিয়ে আছিস! দেখিস নি যে কোন সিনেমায় এই জংলী চরিত্র গুলোকে কেমন দেখায়। আর হ্যাঁ কয়েকটা ঝুমুর গান, ছৌ নাচ, সাঁওতালদের লাফানো নাচ ঢুকিয়ে দে, পরে এটা নিয়ে গবেষণা হতে পারে।
ও হাড়িয়া আর মদ কিন্তু অবশ্যই থাকতে হবে।
স্যার বলছিলাম যে সংলাপ কি হবে?
আরে তুই তোকারি মিশিয়ে চরিত্রদের মুখে সংলাপ দিয়ে দে। কিছু রোমান্টিক প্লট কিন্তু রাখিস, যেমন ধর তোর নায়িকা জ্যোৎস্না রাতে নদীর ধারে পর পুরুষের সাথে দেখা করতে গেছে।
কিরে ব্যাটা সবই যে বলে দিলাম! ঠিকমতো মাল মশলা দিয়ে লিখে দে, দেখবি কেল্লাফতে। মাঝখানে নায়িকাকে শহরে নিয়ে আয়, তাকে দিয়ে জোকারের মতো কিছু কান্ড করা। এই ভাবেই একবার গ্রামে, একবার শহরে করে চালিয়ে দে। একেবারে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। পাঁচ বছর পর তোর সিরিয়াল টপে।
সত্যি স্যার আপনি ধন্য ! চরণধূলি দিন।







নিয়তির পরিহাস

- অর্ঘদীপ মল্লিক


অন্ধকার তখনও ঠিক হয়নি। মুখার্জিদের বাড়ির পিছনে বাঁশবাগানের জোনাকির দল সাঁজ জ্বালাবার উপক্রম করছিলো। তালপুকুরের পাড়ে গাছের মাথায় বাদুড়ের দল কালো হয়ে ঝুলছে। মাঠের ধারে বাঁশবাগানের পিছনটা সূর্যাস্তের শেষ আলোয় উজ্জ্বল। চারিদিকে বেশ কবিত্ব পূর্ণ হয়ে আসছে, ঠিক ঐ সময় মুখার্জিদের অন্দর থেকে তুমুল কলরব আর হইচই শুরু হল।
‌ ভজহরি নিয়ম করে রোজ সন্ধ্যায় হুঁকোতে টান দেন। "ভজহরি মুকুজ্জে" গাঁয়ের এক স্বনামধন্য বিত্তশালী ব্যাক্তি। তিনি নিজের বিলাসিতাতে এতটাই নিয়মানুবর্তিতায় থাকেন যে পান থেকে চুন খসলেই বিপদ। তিনার মতে চুন তো পান এই থাকার কথা, খসার তো কথা নয়। তা খসবেই বা কেনো। আজ চুন অর্থাৎ তার প্রিয় হুঁকোর সাজিটা নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দেখো দেখি কান্ডখানা! তাই সন্ধ্যের অন্দরমহল কোলাহলে মাথায় করে রেখেছেন। বাড়ির ছোটো থেকে বুড়ো সকল সদস্যবৃন্দ হুঁকোর সাজি খোঁজার নিমিত্তে বদ্ধ ও পরিকর। এই বিশেষ সংবাদখানা পুরো পাড়ায় ছড়িয়ে পড়লো। বাড়ির অন্দরমহলে ধীরে ধীরে ভিড় বাড়তে থাকে। প্রায় ঘন্টাখানেক খোঁজার পরেও না পাওয়ায় বাড়ির সদস্যগনের মধ্যে ভীতির সঞ্চার ঘটে। শুধু মাত্র মোক্ষদা ঠাকুরণের মনে খুব আনন্দের উচ্ছ্বাস। যে নেশা তিনি তার স্বামীর থেকে বিগত ষাট বছরে ছাড়াতে পারেননি তা হয়তো আজ ছাড়তে চলেছে। এই আশা নিয়ে ঠাকুরদালানের একটা কোনে মোক্ষদা ঠাকুরন বসে রয়েছে তা দেখে ভজহরি অন্দরমহলের বারান্দার কেন্দ্রে থাকা আরামকেদারা থেকে উঠে বসে বলে উঠে,"আমি জানি কে নিয়েছে। যদি না দাও তবে ভালো হবে না। আমি দক্ষযজ্ঞ লাগিয়ে দেব।" মা ঠাকুরনের দিকে মুখ করে বলেন। তার প্রতুত্তরে মোক্ষদা গলা চড়িয়ে বলে উঠেন,"আ মোলো যা,এখান আবার কেমন ধারার কথা। নিজের স্ত্রী কে সন্দেহ করে কিনা। যদি নিয়ে থাকিত বেশ করেছি। গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিয়েছি।" এ কথা শুনে মুকুজ্জে আরো তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে। এই মহাসঙ্কটময় ক্ষণে কিশোরী বাবুর উপস্থিতিতে সব্ভুলে ভজহরি বিস্মিত। তিনি বিস্মিত এই কারনে যে বস্তুর নিয়ে সন্ধ্যে থেকে সমস্যাতে সবাই সেই বস্তু কিশোরীর হাতে। তখন কিশোরী সবাই কে তার সম্মুখে দেখে রীতিমতো ভীত কম্পিত হস্তে হুঁকোর সাজি ধরে রয়েছে তখন ভজহরি হাল্কা হাসিমুখে বললেন,"আরে ও কিছু না কিশোরী, তুমি যে কাল ওটা নিয়ে গেছো তা মাথা থেকে এক্দমেই বেরিয়ে গেছে। ওটারই খোঁজ চলছে। এসো বসা যাক।" হ্যাঁ ভজহরি একটু আনমনা ভুলো রকমের।
"বয়স হলে যা হয় আর কি।" - কিশোরী হুঁকোটা টেবিলে নামিয়ে রেখে ভজহরিকে বলে। সবাই নিজ নিজ কাজে মন দিল। পাড়ার লোকের ও ভিড় কমল। কিন্তু মোক্ষদা আশহত হয়ে বিড়বিড় করে " ওসব খেয়েই মর।" বলে মুখ বাকিয়ে উঠে রান্না বসানোর কাজে বৌমা ও অন্য চাকরদের হাঁক পাড়ে।
সন্ধ্যা ক্রমে ঘন অন্ধকার হলে অন্দরমহলে হ্যারিকেন ও লম্ফ জ্বলে ওঠে। মোক্ষদার পুত্রবধূ এত ঝামেলার মাঝে ঠিক সময়ে সন্ধ্যা দিয়েছে তা তুলসি মঞ্চে সন্ধ্যা প্রদীপের আলোর শিখা তে নিশ্চিত হলেন। ভজহরির প্রতি আশহত হতাশার রাগ উগরে দেবে বলে রান্নাঘরে এসে দেখেন পুত্রবধূ অগ্রিম রান্নার কাজ আরম্ভ করেছে। কিন্তু শাশুড়ি কে না ডাক দেওয়ার অপরাধে প্রায় আধঘন্টা ধরে রান্নাঘর থেকে বাড়ীর অন্দরমহলে রীতিমতো একটা কবির লড়াই চলতে লাগল। এদিকে বাড়ীর বারান্দায় বসে মোক্ষদা রাগে গর্জে ফুপিযে উঠছে। রান্নাঘর থেকে পুত্রবধূ লাবণ্য প্রথমটা অপ্রতিভ হলেও সামলে নিয়ে এমন সব কথায় শাশুড়িকে জবাব দিতে লাগল যা একজন কুড়ি বছর বয়স্ক তরুণীর মুখে সাজে না। পক্ষান্তরে স্বামীর হুকোর নেশা অবিচল থাকা ও পুত্রবধূর কাছে অপমানে ক্ষিপ্ত প্রায় ভজহরি বধু মোক্ষদা দেবী পুত্রবধূ পিতৃকুল ও নিজেও পিতৃকুলের তুলনামূলক সমালোচনায় প্রবৃদ্ধ হয়ে এমন সব দুরহ পারিভাষিক শব্দের ব্যবহার করতে লাগলেন যে বোধহয় বিদ্যাসাগরের গল্প উল্লেখিত কুলাদর্শ অধ্যায়ন না করলে সে সব বুঝে ওঠা একেবারে অসম্ভব। এইরূপ শাশুড়ি-পুত্রবধূকে বাকবিতণ্ডায় বিদ্বেষ মনোভাব দেখে কিশোরী " এখন আসি। কাল আবার দেখা হবে" বলে চম্পট দেয়। ভজহরি ঘাড় নেড়ে ঘুমোনোর অভিনয়ে সাংসারিক কলরব শুনতে মনে হয়। খানিক বাদে মোক্ষদার গলার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। মোক্ষদা তখন ও পুত্রবধূর নিন্দায় পঞ্চমুখ। " বলি কথা খান কানে যায় না নাকি একজন বয়স্ক মানুষের খাবার অনিয়ম হলে যেন কত অসুবিধা।" - উচ্চস্বরে বেহাগ রাগ এর সুরে বলতে লাগলো। ভজহরি আরামকেদারা ছেড়ে টেবিলে বসলে তার খাবার আয়োজিত করা হয়। তখন ভজহরি পুত্র আলাপন অন্দরমহলে প্রবেশ করায় মোক্ষদা পুত্রবধূর সাংসারিক কাজে অন্যমনস্কতার কথা শোনাতে শুরু করে। আলাপন নির্জন কক্ষ থেকে বেরিয়ে বলে- "মা! লাবুকে তো ঘরে দেখতে পেলাম না। তুমি জানো কি কতক্ষণ নেই।"
" ও মুখপুড়ি তো সন্ধ্যেই বেরোলো। আর ফেরার নামগন্ধ নেই, তুই খেয়ে নে মুখপুড়ি এসে যাবে। " - মোক্ষদার এরূপ মন্তব্যের সাড়া না দিয়ে "নাহ! বাইরেটা থেকে একটু দেখে আসি।"- বলে আলাপন বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যায়। ছেলের এই মূর্তি দেখে মোক্ষদা স্বামীর দিকে বিস্ফোরক চোখ করে বিড়বিড় করতে শুরু করে দিলো। ভজহরি খেয়েদেয়ে শান্ত মাথায় টেবিল থেকে উঠে আরামকেদারায় বুকের উপর হাত দিয়ে শুয়ে পড়ল।
আলাপন বাড়ি থেকে টর্চ নিয়ে বের হয়। রাস্তার অন্ধকারে ক্লান্ত শরীরে এলোপাতাড়িভাবে টর্চ মেরে এদিক-ওদিক দেখতে লাগল । কিছুটা এগোনোর পর সে রীতিমত ভীত-সন্ত্রস্ত। মনে যেন কু-ডাক দিচ্ছে। নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে, ডানদিক থেকে বাঁদিকে টর্চ মারতে দূরে একটা নর্দমার পাশে নারীর অবয়ব দেখে ভয়ে ভয়ে পা সটরে সটরে এগোতে থাকে। অদূরে গিয়ে দেখে লাবণ্যের রক্তাক্ত শরীর যন্ত্রণায় কাতর হয়ে ছটফট করছে। পুরো শাড়িটা নিচের অংশে রক্ত। ওই অবস্থায় আলাপন বউকে কাঁধে করে বাড়ির অভিমুখে হাঁটা শুরু করে। মন শক্ত করে বাড়ির অন্দরমহলে বউকে নিয়ে হতাশ ও ভীত-সন্ত্রস্ত মুখে কান্নায় ঢলে পড়ে। এই অবস্থায় মোক্ষদা বাইরে বেরিয়ে আসে। ততক্ষণে ভজহরি ও তার পুত্র মেঝেতে মাদুর পেতে ডাক্তার কে ফোন করার জন্য উদ্যত। ডাক্তার কে দেখে তাড়াতাড়ি আসতে বলা হয়। মোক্ষদা রক্ত ও পুত্রবধূর মরণাপন্ন অবস্থা দেখে ধর্ষণের অনুমানটা ঠিক আন্দাজ করেছে। সেটা আলাপন আগেই আন্দাজ করেছিল ।এইরূপ অবস্থায় বাড়ির সকলে পুত্রবধূকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকার এর ন্যায় মাথায় হাত দিয়ে বসে রয়েছে। ঠিক তখন ডাক্তার ধর সাইকেল বাড়ির বাইরে দাঁড় করিয়ে বাড়িতে ঢুকে দেখে যেসব সদস্য বৃন্দ নিশ্চুপ। এমনকি মোক্ষদাও। একটু এগোতেই দেখে লাবণ্যর রক্তাক্ত অর্ধনগ্ন দেহ নিথর ভাবে পড়ে রয়েছে। কাছে গিয়ে সবকিছু দেখে বলে "এটা হয়তো ধর্ষণ। পুলিশ ডাকতে হবে। আমার তেমন কিছু করার নেই। যা করবে সবই পুলিশেরই "। একথা শুনে মোক্ষদা- "না পুলিশ কেন বাপু। এই মেয়ের জন্য বাড়িতে পুলিশ আসবে। পুরো পরিবারের মান-সম্মান ধূলায় মিশিয়ে দিলে" । ডাক্তার পুলিশকে ডাকা নির্দেশ দিয়ে আলাপন কে হাসপাতালে নিয়ে আসার আর্জি জানায়। কিন্তু মোক্ষদা না করায় ডাক্তারবাবু কিছু ঔষধ দিয়ে বলে- "দেখুন, এটা একটা সুরাহা হওয়া দরকার। এই ওষুধগুলো দিয়ে ঠিক হতে পারে। আর কি করা যায় বলুন"- ডাক্তার এই বলে চলে গেলেন।
রাত তখন ঠিক 10:30 ছুঁই ছুঁই। রাস্তায় পুরো নিস্তব্ধতা। কিছু জন রাস্তার লোকেরা ছিল তারা জিজ্ঞেস করলে বলা হয় "লাবণ্য ওর শরীরটা ঠিক নেই"। বাড়ির বারান্দার এক কোনায় লাবণ্য মাদুরে শুয়ে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়ে রয়েছে। নিষ্ঠুর শাশুড়ি তাকে না সেবা করে বাড়ির ভিতরে চলে যায়। পাশে শুধুই স্বামী। স্বামী ও তার পাশে বেশিক্ষণ থাকলোনা শয়নকক্ষে পদার্পণ করল কিন্তু শাওন কক্ষের মালিকানা লাবণ্যের ও ছিল। ছিল তার অধিকার সেই কক্ষে শোয়ার কিন্তু তাকে শোয়ানো হলো না, পড়ে রইল ওই বারান্দার এক কোণে মাদুরের উপরেই।
যন্ত্রনা, কষ্ট, দুঃখ এ লাবন্য কাতর হয়ে ভাবছে, যদি সে সুস্থ হয়ে ওঠে তবে সে তার বাপের বাড়ি চলে যাবে। এখন তার মায়ের অনুপস্থিতি যেন তার যন্ত্রণাকে ক্রমে বৃদ্ধি করছে।
আধ খোলা চোখে সে জানলার দিকে তাকায়, জানালার বাইরে ওগুলো কি ভাসছে? সেই যে তার স্বামী গল্প করতো জ্যোৎস্না-রাত্রে পরীরা সব খেলা করে বেড়ায়, তারাই তো নয়? তার বিয়ের রাত্রে কেমন সুন্দর বাঁশি বাজিয়ে ছিল, কি সুন্দর তার সুর, অমন বাঁশি নদীর ধারে অনেক পড়ে থাকে। লাবণ্যের চোখের জ্যোতি ধীরে ধীরে ম্লান হতে লাগল। মনে ভাবতে লাগল, পিওনে মায়ের চিঠি দিয়ে গেল না কেন? এই মাসেই তো আসার কথা ছিল এই ভাবতে ভাবতে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে চোখ বুজে ঘুমিয়ে গেল।
পরদিন সকালবেলা পুত্রবধূ উঠেছে কিনা দেখার জন্য, মোক্ষদা বারান্দায় থেকে উঁকি মেরে দেখল পুত্রবধূ জ্বরের ঘোরে অচেতন অবস্থায় ছেঁড়া মাদুরে উপরেই পড়ে রয়েছে। চোখ দুটি জবাফুলের মত লাল। সেদিন সমস্ত রাত এভাবেই কেটে গেল তার দিকে বিশেষ কেউ নজর দিলো না। কেননা লাবণ্য তাদের বাড়ির কলঙ্ক। তার সব থেকে বড় ভুল সে ধর্ষিতা। তাই সে কলঙ্কিতা। যদি শেষে রাতে না বের হতো তবে হয়ত আজ তার দিনটা অন্যভাবে কাটতো। না বেরহলে হয়তো পরপুরুষে তার দেহ ছেড়ে খেতো না। হত না তার ধর্ষণ। কিন্তু বেগতিক দেখেতার স্বামী ডাক্তার ডেকেছিল। পরিবারের সম্মানের চিন্তায় পুলিশকেও ডাকা হল না , নিয়ে যাওয়া হলো না লাবণ্যকে হাসপাতলে হয়ে পড়ে রইল লাবণ্য সেভাবেই। মত রাত্রে সে জ্বরের ঘোরে ভুল বকতে লাগলো- "সত্যিই ভুলটা কি আমারি ছিল । ওরা যা বলছে, আমি অন্যভাবে..." ইত্যাদি ইত্যাদি।
ভোর হবার কিছু পূর্বে সে মারা গেল। তার শরীর যেন এ জন্মে ব্যথা থেকে মুক্তি পেল। তার আত্মা শরীর ছেড়ে যাবার সময় যেন বলে গেল -

"একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ, প্রাণেশ হে,
আনন্দবসন্তসমাগমে।।
বিকশিত প্রীতি-কুসুম হে,
পুলকিত চিতকাননে।।
জীবনলতা অবনতা তব চরণে,
হরগীত উচ্ছ্বাসিত হে,
কিরণমগন গগনে।।"
    

তার মৃত্যুতে মুখুজ্জে-ভবন শান্তির শ্বাস ফেলল। ঘরে কাক-চিল গুলো নতুন অভিজ্ঞত সাক্ষী হলো। কিছুদিন পরেই আলাপন পুনরায় দ্বিতীয় পক্ষের বউকে বিয়ে করে ঘরে আনল। পড়ার সবাই বলল মণিকুন্তলা রূপে লক্ষ্মী ,গুণে সরস্বতী। আগেরটার থেকে ঢের ভালো। তাকে দেখলে নাকি চোখ জুড়ায় যায় এমন সুন্দর মেয়ে কর্মপটু, হুশিয়ার, গোছালো। আলাপন কিন্তু নিজেকে কেমন একটা করে রেখেছে । প্রথম পক্ষকে যেভাবে নিজের করে ছিল দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তা হলোনা । বাড়ি ও সমাজের চাপে এই বিয়েটা করতে বাধ্য হয়েছিল । এই বিয়ের অন্যতম কারণ মোক্ষদা ঠাকুরের সেই 68 বছর পুরানো জেদ। দ্বিতীয় বিবাহের পর অল্প দিনে আলাপন পোস্ট অফিসের পিয়ন এর কাজটা পেল। সকলে বলাবলি করতে লাগল যে এই পক্ষের বৌ আসায় নাকি আলাপনের কপাল ভালো হয়ে গেছে। তাই তো চাকরীটা পেল।
সেদিন যখন কাজ সেরে সন্ধ্যার দিকে রাস্তা দিয়ে ফিরছিল তখন সে লাবণ্যের ধর্ষিত দেহের কথা মনে পড়ে যায়। তখন থেকে সে খুব অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আস্তে আস্তে দেখে যে সে ভুল রাস্তায় এসে গেছে। বড় রাস্তার মাঝখানে হাঁটছে, সেটা যতক্ষণ সে বুঝে উঠে ততক্ষণে সে লরির ধাক্কায় মৃত। তার মৃতদেহ, রাস্তার পাশের ঝোপের পড়ে রইল। যেন নিয়তি আলাপনের জীবনের সমাপনের মধ্যে দিয়ে বুঝাতে চাইলো, সেদিনের কুড়ি বছরে লাবণ্যের কষ্টের কিছু অংশ।।